অবৈধ সংযোগ ও ত্রুটিপূর্ণ লাইনে গ্যাস সরবরাহ: বাড়ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি, অপচয় ও দূষণ
2024.02.28
ঢাকা
রাজধানী ঢাকা এবং এর আশপাশের এলাকায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড পুরোনো ও ত্রুটিপূর্ণ লাইনে গ্যাস সরবরাহ করায় বাড়ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি, অপচয় ও দূষণ।
মঙ্গলবার ঢাকার শাহজাহানপুর এলাকার একটি বাসায় তিতাসের গ্যাস লিকেজের কারণে আগুন লেগে কমপক্ষে ছয় জন দগ্ধ হন। এই দুর্ঘটনার পরে ঝুঁকির বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে।
তিতাসের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত তিন লাখের বেশি অবৈধ গ্যাস সংযোগ চিহ্নিত এবং প্রায় ৬২০ কিলোমিটার অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তিতাসের যোগসাজশ ছাড়া লাখ লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগ স্থাপন সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম বেনারকে বলেন, “বাসা-বাড়ি, শিল্প স্থাপনা, সিএনজি ফিলিং স্টেশনসহ সব জায়গায় অবৈধ সংযোগ রয়েছে। এসব অবৈধ সংযোগের কারণে কোম্পানি অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে। তাছাড়া, কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছে না। অবৈধ সংযোগ ও পাইপলাইনের ছিদ্রের কারণে মানুষের সুরক্ষা হুমকির মুখে। যে কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।”
তিনি বলেন, “আমরা প্রায়ই গণমাধ্যমে দেখি গ্যাস বিস্ফোরণে মানুষ দগ্ধ হয়েছে অথবা প্রাণ হারিয়েছে। সর্বশেষ কয়েকদিন আগে নারায়ণগঞ্জে গ্যাস বিস্ফোরণে একটি পরিবারের সদস্যরা আহত হয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবৈধ সংযোগ ও পাইপলাইনে ছিদ্রের কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে।”
অধ্যাপক তামিম বলেন, “অনেক সময় আনাড়ি টেকনিশিয়ানরা পাইপলাইন ছিদ্র করে অবৈধ সংযোগ দেয়। এসব ছিদ্র দিয়ে গ্যাস বেরিয়ে জমে থাকে এবং এক সময় বিস্ফোরণ ঘটায়।
“পাইপলাইন থেকে গ্যাস সরাসরি বায়ুমণ্ডলে চলে যাওয়ায় পরিবেশ দূষণ হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মিথেন গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চেয়ে অনেক বেশি দায়ী,” বলেন তিনি।
তিতাস কর্মীদের ‘সহায়তা ছাড়া’ অবৈধ সংযোগ নেয়া সম্ভব নয়
অবৈধ সংযোগের ব্যাপারে অধ্যাপক তামিম বলেন, “তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তা ছাড়া অবৈধ সংযোগ নেওয়া অসম্ভব। একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে পাইপলাইন ছিদ্র করে সংযোগ নেওয়া সম্ভব নয়।”
কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ সংযোগের সঙ্গে কারো সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং তাঁরা অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছেন। একইসঙ্গে পাইপলাইনের ছিদ্র মেরামতের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গত বছর এক সংবাদ সম্মেলনে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ জানান, অবৈধ সংযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে ২২৮ জন কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আট জনকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে, ১৬ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং কমপক্ষে ৫৫ জন ঠিকাদারের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
অধ্যাপক তামিম বলেন, তিতাসের সিস্টেম লস শতকরা তিন ভাগ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য কিন্তু সেটি এখন প্রায় দ্বিগুণ।
তিতাস গ্যাস কোম্পানির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সিস্টেম লস পাঁচ দশমিক ২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত দুই অর্থবছরে এই হার ছিল শতকরা দুই শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরে তিতাস মোট ১৪ হাজার ৪৫৯ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস সরবরাহ করেছে। পাঁচ শতাংশ সিস্টেম লস হিসাবে প্রায় সাত হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অপচয় হয়েছে বলে জানিয়েছে তিতাস।
ওই অর্থবছরে কর্তৃপক্ষ প্রায় তিন লাখ ২৮ হাজার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও ৩৯০ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন ধ্বংস করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় দুই লাখ ৭৫ হাজার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও ৩৪০ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন ধ্বংস করা হয়।
অধ্যাপক তামিমের সঙ্গে একমত পোষণ করে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি শামসুল আলম বলেন, তিতাসের কর্মচারী ও ঠিকাদারদের সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেওয়া সম্ভব নয়।
তিনি বেনারকে বলেন, “তিতাসের কিছু অসাধু ঠিকাদার ও কর্মকর্তা মূল পাইপলাইনে ছিদ্র করে বিকল্প পাইপলাইনের মাধ্যমে অবৈধ সংযোগ দেয়। তাদের কাছে সব ধরনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম রয়েছে।”
শামসুল আলম বলেন, অনেক সময় একটি প্লটের বিপরীতে একাধিক অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিতাস পরিচালক (অপারেশন) সেলিম মিয়া বেনারকে বলেন, “আমরা জানি, সঞ্চালন লাইনে ছিদ্র রয়েছে। তবে কত সংখ্যক ছিদ্র রয়েছে, সেটি আমাদের জানা নেই। মাঝে মাঝেই আমরা লাইন পরীক্ষা করি, ছিদ্র দেখা গেলে সেগুলো দ্রুত মেরামত করা হয়।”
তবে অবৈধ সংযোগের জন্য তিতাসের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা তিনি অস্বীকার করেন।
প্রতি বছর কয়েক হাজার অভিযোগ
দেশে যে ছয়টি গ্যাস সরবরাহ কোম্পানি রয়েছে, তার মধ্যে তিতাস সর্ববৃহৎ। ঢাকা ও পাশের জেলাগুলোতে মোট সরবরাহের শতকরা ৫৫ শতাংশ তিতাস দিয়ে থাকে।
১৯৬৪ সালে প্রথমবারের মতো গ্যাস সরবরাহ লাইন স্থাপন করে তিতাস। এরপর বিভিন্ন সময়ে নির্মাণ করা হয় সরবরাহ নেটওয়ার্ক।
তিতাসের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে চার হাজার ৮৯১ জন ফোন করে সঞ্চালন লাইনে ছিদ্র হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। পরের অর্থবছরে অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৭৯৬টি।
তিতাসের হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে গ্যাস সঞ্চালন লাইনের ত্রুটি থেকে ৩১১টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রকৃত দুর্ঘটনার সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও আশে পাশের জেলায় তিতাসের প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইন রয়েছে। গ্রাহকদের অভিযোগ, অনেক অংশে অগণিত ছিদ্র রয়েছে।
গত ২৪ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে একটি বাসায় গ্যাস থেকে বিস্ফোরণে কমপক্ষে কমপক্ষে ছয় জন দগ্ধ হন। তাঁদের মধ্যে দুই জন পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের সহকারী উপপরিচালক ফখর উদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “২৪ জানুয়ারি সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। শুধু সিদ্ধিরগঞ্জ নয়, পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলায় অনেক অবৈধ গ্যাস লাইন রয়েছে এবং গ্যাস পাইপলাইনে ছিদ্র রয়েছে। ফলে কিছু দিন পরপর গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।”
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বেনারকে বলেন, “তিতাসের যে পাইপলাইন সেটি অনেক পুরাতন। এই লাইনে অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে। এগুলো ঢাকা ও আশেপাশের জেলার কোটি কোটি মানুষ ও স্থাপনার জন্য বিরাট হুমকি। পুরাতন এই লাইনগুলো মেরামত অথবা প্রতিস্থাপন করা জরুরি।”
সেলিম মিয়া আরও বলেন, “সঞ্চালন লাইনের মানোন্নয়নে আমরা পাইপলাইন প্রতিস্থাপনের কাজ শুরু করছি। প্রথম পর্যায়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পাইপলাইন প্রতিস্থাপন করা হবে। সেই লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে।”