পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রান্নায় গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার ও দুর্ঘটনা

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.03.27
ঢাকা
পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রান্নায় গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার ও দুর্ঘটনা ঢাকার লালবাগ এলাকায় ফুটপাতের ওপর সিলিন্ডার রেখে ইফতার সামগ্রী তৈরি করছেন একজন হোটেল কর্মচারী। ২৭ মার্চ ২০২৪।
[মেহেদী রানা/বেনারনিউজ]

হোটেল-রেস্তোরাঁর পাশাপাশি বাংলাদেশে রান্নার কাজে বাসা-বাড়িতেও গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার বাড়ছে। একই সাথে বাড়ছে গ্যাস লিকেজ থেকে দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা।

দুর্ঘটনা বাড়ার কারণ হিসেবে অবহেলা, অসতর্কতা এবং সিলিন্ডার ব্যবহারে সঠিক ধারণা না থাকার বিষয়গুলোকে দায়ী করছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তা ও জ্বালানী বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও গ্যাস উৎপাদনকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুসারে, গত বছর সারা দেশে ২১০টি দুর্ঘটনায় চারজন প্রাণ হারিয়েছেন, দগ্ধ হয়েছেন ২৩ জন।

২০২২ সালে গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ১৪টি, দগ্ধ হন ৪৬ জন। এর আগে ২০২১ সালে একইরকম ৫৭টি দুর্ঘটনায় আহত হন ৫৭ জন।

এদিকে গত ১৩ মার্চ গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার দুর্ঘটনায় দগ্ধ হওয়া ৩৬ জনের মধ্যে ১৫ জনই মারা যান। সর্বশেষ মঙ্গলবার ওই ঘটনায় আহত একটি শিশু মারা গেছে।

গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহারবিধি জরুরি

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম বেনারকে বলেন, সরকার ঘোষণা দিয়েছিল ২০০৯ সালের পর থেকে বাসা-বাড়িতে পাইপলাইনের মাধ্যমে আর গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে না। সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হবে।

“পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের কারণে প্রচুর গ্যাস অপচয় হয়,” জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে দুর্ঘটনা বাড়ছে।”

সিলিন্ডার ব্যবহারে দুর্ঘটনা বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বদরুল ইমাম বলেন, সিলিন্ডার বিক্রির সময় কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের ব্যবহারবিধি সংক্রান্ত তথ্য বা সতর্কতামূলক লিফলেট দেয় না, ফলে সাধারণ মানুষ সঠিকভাবে ব্যবহারের নিয়ম জানে না।

“সরকারের উচিত একটি বিধান করা, যাতে কোম্পানিগুলো গ্যাস সিলিন্ডারের সঙ্গে ব্যবহারবিধি দিতে বাধ্য থাকবে,” বলেন তিনি।

কীভাবে লিকেজ থেকে দুর্ঘটনা

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “সিলিন্ডার থেকে গ্যাস লিকেজ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ব্যবহারকারীরা জানেন না কীভাবে সিলিন্ডারের সঙ্গে রেগুলেটর আটকাতে হয়।”

আনোয়ার অগ্নি প্রতিরোধ কর্মসূচির দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক। তিনি বলেন, যে পাইপ দিয়ে চুলায় গ্যাস নেওয়া হয় সেখানে ছিদ্র থাকলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, আবার অনেক সময় রাইজার থেকে গ্যাস বের হয়েও দুর্ঘটনা ঘটে।

“আমাদের বেশিরভাগ বাসা-বাড়িতে বাতাস চলাচলের ভালো ব্যবস্থা থাকে না। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব,” বলেন আনোয়ার।

মিরপুর এলাকায় গ্যাসের চুলা মেরামত করেন আব্দুস সালাম। তিনি বেনারকে বলেন, “পরিবহনের জন্য যেভাবে ট্রাকে তোলা ও নামানো হয়, তাতে সিলিন্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় সিলিন্ডার গড়িয়ে গড়িয়ে নেওয়া হয়। ফলে সিলিন্ডার ক্ষয়ে যায়।”

নওগাঁ জেলার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমরা নিজেরাই সিলিন্ডারে রেগুলেটর আটকাই। বাড়ির প্রায় সবাই এই কাজ পারেন। এমনি তো গ্যাস লিকেজ বোঝা কঠিন, গ্যাসের গন্ধ বের হলে আমরা মিস্ত্রি ডাকি।”

চলতি বছরে বড়ো দুর্ঘটনা

গত ১৩ মার্চ গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় টপ স্টার গার্মেন্টস কারখানার কাছে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের কলোনিতে সিলিন্ডার থেকে অগ্নিকাণ্ডে সাত শিশুসহ ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ওই ঘটনায় মোট ৩৬ জন দগ্ধ হন, যাদের মধ্যে ২১ জন শঙ্কামুক্ত।

গাজীপুর জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল আরেফীন বুধবার বেনারকে বলেন, সিলিন্ডারের সঙ্গে রেগুলেটর যথাযথভাবে না লাগায় গ্যাস বের হচ্ছিল। সে সময় অনেক মানুষ এগিয়ে আসেন। বিপদ থেকে রক্ষা পেতে একজন সিলিন্ডারটি ছুড়ে মারেন। পাশেই আরেকটি চুলায় রান্না হচ্ছিল। সিলিন্ডারটি সেই চুলার আগুনের সংস্পর্শে এলে এই দুর্ঘটনা ঘটে।

বুধবারও সিলিন্ডারের আগুনে দগ্ধ ৪

ঢাকার ধামরাইয়ে সিলিন্ডার থেকে আগুনের ঘটনায় বুধবার চারজন আহত হয়েছেন।

দমকল বাহিনীর ফায়ার ফাইটার এরশাদ আলী মৃধা বেনারকে বলেন, ধামরাইয়ের মোকামটোলা এলাকায় একটি বাড়ির নিচতলায় বুধবার ভোরে সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বেরিয়ে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

তিনি বলেন, “ওই বাসায় পাইপলাইনে গ্যাস না থাকায় বিকল্প হিসাবে সিলিন্ডার কিনে ব্যবহার করতেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা নান্নু মিয়ার পরিবার। ভোরে সেহরির জন্য রান্না করতে গেলে বিকট শব্দে বাসার ভেতরে আগুন লেগে যায় এবং জানালার কাচ ভেঙ্গে যায়। বাসার অনেক আসবাবপত্র পুড়ে গেছে।”

“আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, সিলিন্ডার থেকে গ্যাস লিক হয়ে পুরো বাসায় ছড়িয়ে পড়ে। আগুন ধরার সাথে সাথে বিস্ফোরণ ঘটে,” বলেন এরশাদ আলী।

ওই ঘটনায় আহতরা হলেন নান্নু মিয়া (৬২), সুফিয়া বেগম (৪৮), মেয়ে আক্তার মৌ (২৩) এবং পুত্র সোহাগ (১৯)।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গ্যাস সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করে থাকে। সেই অনুযায়ী বাজারে মূলত বেসরকারি উদ্যোগে সিলিন্ডার বিক্রি হয়।

সরকারি হিসাবে, গত ছয় বছরের ব্যবধানে এলপিজি ব্যবহার বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ২০১৭ সালে ব্যবহার হতো সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিক টন, গত বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ টন।

বাংলাদেশে প্রায় চার কোটি এলপিজি সিলিন্ডার রয়েছে। প্রায় পাঁচ হাজার ডিলারের মাধ্যমে ৬০ লাখের বেশি গ্রাহক এই গ্যাস সিলিন্ডার সংগ্রহ করে থাকেন। সেই গ্যাস ব্যবহার করতে গিয়েই ঘটছে বিভিন্ন দুর্ঘটনা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।