নারী-পুরুষের বৈষম্য কমাতে বরাদ্দ বাড়লেও বৈশ্বিক সূচকে পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ
2022.07.14
ঢাকা

নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক বৈষম্য কমাতে গত এক যুগে সরকারি বাজেটে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। বর্তমান অর্থ বছরে প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
অথচ গত দুই বছর ধরে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমেই অবনতি হচ্ছে।
বুধবার প্রকাশিত গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ প্রতিবেদন-২০২২ অনুযায়ী, ১৪৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম, যা ২০২১ সালে ছিল ৬৫তম ও ২০২০ সালে ৫০তম।
তবে বৈশ্বিক অবস্থান অবনমন হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে ভালো।
এই সূচকে গতবারের মতোই শীর্ষে অবস্থান করছে আইসল্যান্ড। অন্য শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, সুইডেন, রুয়ান্ডা, নিকারাগুয়া, নামিবিয়া, আয়ারল্যান্ড ও জার্মানি।
সূচকের সবচেয়ে নিচে রয়েছে আফগানিস্তান।
প্রতিবেদনে মোট চারটি মানদণ্ডে বিভিন্ন দেশের অবস্থান বিচার করা হয়েছে। এগুলো হলো; অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ, শিক্ষায় অর্জন, স্বাস্থ্য ও টিকে থাকা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বের আটটি অঞ্চলের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থান সবচেয়ে নিচে। বলা হয়, এই অঞ্চলে বাংলাদেশ ও নেপাল অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে ভালো করেছে।
এদিকে গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ সূচকে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার “সুনির্দিষ্ট কারণ” জানা নেই বলে বৃহস্পতিবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন সরকারের মহিলা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদা পারভীন।
তবে তিনি বলেন, ২০২০-২১ সালে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে নারীদের জন্য নেয়া বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়নি।
“যেখানে আমরা কোনো একটি কর্মশালায় ৫০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার লক্ষ্য নিয়েছিলাম সেখানে অনলাইনে হয়তো ২০ জনকে দেয়া গেছে,” বলেন ফরিদা পারভীন।
মহামারি পরিস্থিতির কারণে গত অর্থ বছরে বরাদ্দ কিছু অর্থ ব্যবহারও করা যায়নি বলে জানান তিনি।
চার মানদণ্ডে বাংলাদেশ
২০১৭ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭৪ সালে ছেলেদের সাক্ষরতার হার ছিল ৩৫ শতাংশের ওপর এবং মেয়েদের শতকরা ১৮ শতাংশের নিচে।
২০১১ সাল পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে ওই ব্যবধান কমে এসেছে। ২০১১ সালে ছেলেদের সাক্ষরতার হার ছিল ৫৫ শতাংশের কাছাকাছি এবং মেয়েদের প্রায় ৪৮ শতাংশের কাছাকাছি।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, সাত বছর বয়সের বেশি ছেলে-মেয়েদের সাক্ষরতার হারের ব্যবধান ধীরে ধীরে কমে আসছে।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির হার মেয়েদের ক্ষেত্রে শতকরা ৯৮ দশমিক আট ভাগ এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ৯৭ দশমিক এক ভাগ। ওই সালে প্রাথমিক পর্যায়ে ছেলে-মেয়েদের পাশের হার প্রায় সমান, সাড়ে ৯৮ শতাংশ।
মাধ্যমিক পর্যায়ে, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশি ভর্তি হয়। ২০১৫ সালে প্রায় ৭২ শতাংশ মেয়ে ভর্তি হয়েছে। অন্যদিকে ছেলেরা ভর্তি হয়েছে ৬২ শতাংশের কিছু বেশি।
শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে মেয়েদের ঝরে পড়ার কারণ পিতা-মাতার আর্থিক অসঙ্গতি এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে অন্যান্য কাজ করা।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালের লেবার ফোর্স সার্ভে অনুযায়ী, বাংলাদেশের সাড়ে ৮০ শতাংশ পুরুষ কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত। অন্যদিকে নারীদের অবস্থান মাত্র ৩৬ শতাংশের কিছু বেশি।
নারীদের স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অন্যতম সফল মডেল হলো গ্রামীণ কমিউনিটি ক্লিনিক। মেয়েদের টিকা দেয়াসহ প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায় বিশ্বে প্রশংসিত এই মডেল।
দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার এবং বিরোধীদলীয় নেতা নারী। মন্ত্রিসভায় রয়েছের নারী মন্ত্রী। দেশের প্রধান বিরোধীদলের সর্বোচ্চ নেতা নারী। তবে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে তেমন উন্নতি হয়নি বাংলাদেশের।
দেশের ৩৫০ সদস্যের সংসদে ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। এছাড়াও রয়েছেন সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ২৪ নারী সাংসদ।
যা বলছে সরকারি প্রতিবেদন
সরকারের অর্থ বিভাগের বার্ষিক জেন্ডার প্রতিবেদন ২০২২-২৩ অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে জেন্ডার সংশ্লিষ্ট বাজেটের পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা যা ওই অর্থবছরের মোট বাজেটের প্রায় ২৫ শতাংশ।
বারো বছর পর বর্তমান অর্থবছরে সেই অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ২৯ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের প্রায় ৩৪ শতাংশ।
জেন্ডার সংশ্লিষ্ট বাজেট হলো, প্রতিটি সরকারি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের নিয়মিত বরাদ্দ থেকে যে পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমাতে ব্যয় করার জন্য নির্ধারণ করে সেই অর্থ।
অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজেটে নারীর হিস্যা নিশ্চিত করা গেলেও নারী উন্নয়নে অথবা জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণে থিমেটিক এরিয়াভুক্ত মন্ত্রণালয়সমূহে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
বলা হয়েছে, “চ্যালেঞ্জগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিক্ষার সব ক্ষেত্রেই সমধর্মী চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। খুব সাধারণীকরণ মনে হলেও ধর্মীয় অনুশাসনের অপব্যবহার, ইভটিজিং, যৌন হয়রানি, কর্ম অথবা শিক্ষা ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব, অসৌজন্যমূলক ব্যবহার, আনওয়েলকামিং আচরণসহ নানা প্রতিবন্ধকতা উঠে এসেছে।”
বলা হয়েছে, “বিরাজমান সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা নারী উন্নয়নে প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করছে। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রবর্তন করা হলেও এখন পর্যন্ত সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছায়নি।”
প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন
বেসরকারি সংগঠন নিজেরা করি’র প্রধান খুশি কবীর বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো। তবে ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ এবং ২০২২ সালে এই সূচক নিচে নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ করোনাভাইরাস মহামারি।
তিনি বলেন, “মহামারির অন্যতম শিকার নারীরা। ওই সময়ে সারাদেশে, বিশেষ করে উপজেলা পর্যায়ে নারীদের স্বাস্থ্য সেবা দেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার পাওয়া যেত না; আবার অনেক হাসপাতালে করোনাভাইরাস ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসা দেয়া হতো না।”
খুশি কবীর বলেন, “নারীরা কৃষি ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখে চলেছে। কিন্তু সরকারিভাবে তাঁদের অবদানকে দেশের জিডিপি হিসাব করার সময় গণনা করা হয় না।”
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা হলো, আমাদের দেশে নারীদের রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে দেয়া হচ্ছে না। আমাদের অবস্থান অপরিবর্তিত থেকে যাচ্ছে। আমরা ৩৫০ জনের সংসদে সংরক্ষিত আসনসহ ৭৪ থেকে ৭৫ এর বেশি যেতে পারছি না। আমাদের চেয়ে আফ্রিকার দেশগুলো বরং এক্ষেত্রে অনেক ভালো করছে, যারা নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে।”
“নারী-পুরুষের বৈষম্য কমাতে হলে প্রথমে দরকার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন। মনে করতে হবে যে, আমরা নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে চাই। অন্যথায় আমরা বড়ো অর্জন করতে পারবো না,” বলেন খুশি কবীর।