ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে তামাক পণ্যে কর বৃদ্ধির প্রস্তাব শতাধিক চিকিৎসকের

পুলক ঘটক
2021.05.07
ঢাকা
ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে তামাক পণ্যে কর বৃদ্ধির প্রস্তাব শতাধিক চিকিৎসকের বাংলাদেশে প্রকাশ্যে ধূমপানের জন্য জরিমানার আইন থাকলেও তা সচরাচর মানা হয় না। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে তোলা ছবি। ১৭ মার্চ ২০১৯।
[সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ]

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাকজাত পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ রেখেছেন দেশের ১২১ জন স্বনামধন্য চিকিৎসক। শুক্রবার এক বিবৃতিতে তাঁরা জানিয়েছেন, তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারজনিত রোগে বাংলাদেশে প্রতি বছর এক লাখ ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। 

বাংলাদেশকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি তামাক ব্যবহারকারী দেশগুলোর অন্যতম উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, এর বড় কারণ এ দেশে সিগারেটের দাম অত্যন্ত কম, বিড়ি আরও সস্তা। এর ফলে দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা অত্যধিক, যার চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতকে। 

এর প্রেক্ষিতে আগামী জুন মাসের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট সামনে রেখে তামাকজাত পণ্যে কর বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন এই বিশেষজ্ঞরা। 

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের যুক্তি ও মতামতকে যথার্থ উল্লেখ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক শুক্রবার বেনারকে বলেন, “স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সিরিয়াসলি ধূমপানসহ তামাকজাত পণ্য সেবন নিয়ন্ত্রণের পক্ষে।”

“গত বছর আমরা করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় তামাক এবং তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু এটা আমাদের একার কাজ নয়। এর মধ্যে অনেক স্টেক হোল্ডার আছে, এটা একাধিক মন্ত্রণালয়ের সমষ্টিগত কাজ,” বলেন তিনি। 

মন্ত্রী আরও বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে ধাপে ধাপে কঠোরতা আরোপ করা হবে।” 

বছরে তামাকের ক্ষতির পরিমাণ স্বাস্থ্য বাজেটের চেয়ে বেশি 

চিকিৎসকদের বিবৃতিতে বলা হয়, “তামাক কোম্পানিগুলো থেকে সরকার বছরে ২২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পায়। অথচ বছরে তামাকের কারণে স্বাস্থ্য ক্ষতিই হয় ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। আর চলতি বছরের স্বাস্থ্য খাতের বাজেট ২৯ হাজার কোটি টাকা। ফলে দেখা যাচ্ছে, তামাকের কারণে ক্ষতির পরিমাণ স্বাস্থ্য খাতের বাজেটের চেয়েও বেশি।” 

চিকিৎসকদের ওই বিবৃতিতে ২০১৩ সালের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধন করে কঠোর করার ওপর মত দেওয়া হয়। 

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “ইতোপূর্বে তামাকজাত পণ্যের প্যাকেটে ছবির ব্যবহার ছিল না, সেটি করা হয়েছে। পাশাপাশি এক সময় বিমানসহ বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে ধূমপানের সুযোগ ছিল। আইন করে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনটি আরও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে আইনের সংশোধন আনার লক্ষ্যে কাজ চলছে।” 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. আব্দুল মালিক বেনারকে বলেছেন, “তামাকের ব্যবহার কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাকজাত পণ্যের মূল্য বাড়ানো। তামাকের নেশাজাতীয় দ্রব্যের ওপর এমন মাত্রায় কর আরোপ করা উচিত, যাতে মানুষ সস্তায় এই জিনিস কিনতে না পারে।”

“তরুণদের তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য এবং বর্তমান ব্যবহারকারীদের তামাক ছাড়তে উৎসাহিত করতে আমরা তামাক পণ্যে উচ্চ কর আরোপের ওপর জোর দিচ্ছি,” অধ্যাপক মালিক বলেন। 

তবে এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকে ফোন করে এবং এসএমএস পাঠিয়ে সাড়া পায়নি বেনার নিউজ। 

তামাকজাত পণ্য ব্যবহারে যত ক্ষতি

মাদকবিরোধী সংগঠন মানসের সভাপতি ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বেনারকে বলেছেন, “আমরা গবেষণায় দেখেছি, গত পাঁচ বছরে নারীদের মধ্যেও ধূমপায়ীর সংখ্যা বেড়েছে। বাংলাদেশের ১৫ বয়সোর্ধ্ব ৪৩ শতাংশ মানুষ তামাকে আসক্ত যাদের মধ্যে ২৯ শতাংশ নারী।” 

শুক্রবারের যৌথ বিবৃতিতে অধ্যাপক অরূপ রতনসহ ২২১ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেছেন, “বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর প্রধান আটটি কারণের ছয়টির সাথেই তামাক জড়িত। অথচ এটি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন ততটা নই, যতটা হওয়া উচিত ছিল।” 

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস)-এর রিপোর্টের বরাত দিয়ে তাঁরা বলেছেন, তামাক ব্যবহারকারীদের প্রায় অর্ধেকই মারা যান তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের কারণে। তামাক ব্যবহারকারীদের তামাকজনিত রোগ যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, সিওপিডি বা ফুসফুসের ক্যান্সার হবার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ৫৭ শতাংশ বেশি এবং তামাকজনিত অন্যান্য ক্যান্সার হবার ঝুঁকি ১০৯ শতাংশ বেশি। 

এ কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর এক লাখ ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার জনিত রোগে মৃত্যুবরণ করেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে ৩৫ শতাংশ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করেন। সংখ্যার হিসেবে যা সাড়ে তিন কোটিরও বেশি। আবার ১৩ থেকে ১৫ বছরের অপ্রাপ্তবয়স্করাও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার থেকে পিছিয়ে নেই। শতকরা হিসেবে সেটিও প্রায় ৭ শতাংশ।

যারা ধূমপান করেন না, কিন্তু পরোক্ষভাবে ধূমপানের ক্ষতির শিকার হন, এমন মানুষের সংখ্যা সামগ্রিকভাবে মোট ধূমপায়ীর সংখ্যার চেয়েও বেশি। সংখ্যার হিসেবে তা প্রায় ৪ কোটি মানুষ। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব উদ্ধৃত করে চিকিৎসকদের বিবৃতিতে বলা হয়, “২০১৫-১৬ সালের তুলনায় ২০১৭-১৮ সালে মাথাপিছু জাতীয় আয় বেড়েছে ২৫.৪ শতাংশ। অথচ এসময়ে বেশিরভাগ সিগারেটের দাম হয় প্রায় অপরিবর্তিত থেকেছে অথবা সামান্য বেড়েছে। ফলে বর্তমানে সিগারেট অধিক সহজলভ্য হয়ে পড়ছে। এ জন্য কর বৃদ্ধির মাধ্যমে সিগারেটের মূল্য বৃদ্ধি করা জরুরি।”

“বাংলাদেশে ব্র্যান্ড ভেদে সিগারেটে বহুস্তর বিশিষ্ট কর কাঠামো চালু থাকায় বাজারে অত্যন্ত সস্তা এবং সহজলভ্য সিগারেট পাওয়া যায়। ফলে ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে ভোক্তা তুলনামূলক কম দামী সিগারেট বেছে নিতে পারছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিগারেটের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে প্রায় একই রকম রয়েছে,” বিবৃতিতে বলেছেন চিকিৎসকেরা। 

বিবৃতি দেওয়া স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে রয়েছেন, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আফম রুহুল হক এমপি, অধ্যাপক আবদুল আজিজ এমপি, অধ্যাপক হাবিবে মিল্লাত এমপি।

করোনায় বন্ধ করা যায়নি

করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় তামাক কোম্পানির উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন ও তামাকপাতা ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করার জন্য গত বছরের মে মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া একটি প্রস্তাব বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয় নাকচ করে দিয়েছিল। 

ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তামাককে কোভিড-১৯ সংক্রমণ সহায়ক হিসাবে চিহ্নিত করে এর ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার কথা বলেছে। কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলোকে দেয়া উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন করার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমতিপত্র পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। 

এ প্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয় গত বছর একটি ভার্চুয়াল বৈঠক আয়োজন করেছিল যাতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবের পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা যোগ দেন। 

সেখানে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে রাতারাতি এই খাত বন্ধ করে দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না।

বন্ধ না করার যুক্তি হিসেবে বলা হয় তামাক চাষি এবং তামাক শিল্পের শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া বৈধভাবে তামাক উৎপাদন বন্ধ করলে কালোবাজারি হবে এবং সরকার রাজস্ব হারাবে।

শিল্প সচিব মো. আবদুল হালিমকে উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে তখন বলা হয়েছিল, সরকার তামাকের প্রসার বা প্রচারের পক্ষে না হলেও আস্তে আস্তে তা কমিয়ে আনতে চায়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।