বাংলাদেশের ইতিহাসে এপ্রিলে দীর্ঘতম তাপপ্রবাহ
2024.04.26
ঢাকা
বাংলাদেশের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস এপ্রিল হলেও গত ৭৬ বছরের ইতিহাসে এবারই চলছে দীর্ঘতম তাপপ্রবাহ।
এর আগে ২০১৯ সালে একটানা সর্বোচ্চ ২৩ দিন তাপপ্রবাহ হয়েছিল। এবার সেই রেকর্ডও ছাড়িয়ে গেছে। চলমান তাপপ্রবাহ কবে নাগাদ শেষ হতে পারে তা নির্দিষ্ট করে জানাতে পারছে না আবহাওয়া অধিদপ্তর।
তীব্র গরমে সারা দেশে অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে জীবনযাত্রা।
এই অবস্থায় আগামী রোববার থেকে সারা দেশে সব বিদ্যালয়ে নিয়মিত পাঠদান শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা অধিদপ্তর। ঈদুল ফিতরের ছুটি শেষে তাপপ্রবাহ শুরু হওয়ায় ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটির মেয়াদ বাড়ায় সরকার।
শুক্রবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
আবহাওয়া অধিদপ্তর বেনারকে জানিয়েছে, শুক্রবার বিকেলে চুয়াডাঙ্গায় চলতি বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।
গত ২০ এপ্রিল এই জেলায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ শুক্রবার বেনারকে বলেন, “আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত আবহাওয়ার ডেটা রয়েছে। সেই অনুসারে, এ বছরই সবচেয়ে দীর্ঘতম তাপপ্রবাহের মাস বলা যায়।”
তিনি বলেন, “এই বছর একটানা তিন দফায় তাপপ্রবাহ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।”
আবহাওয়া অধিদপ্তর বৃহস্পতিবার তৃতীয় দফায় জানিয়েছে, চলমান তাপপ্রবাহ পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে এবং বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্যের ফলে মানুষের অস্বস্তিকর অনুভূতি বাড়তে পারে।
শুক্রবার সংস্থাটি আরও জানায়, বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ (ভেরি সিভিয়ার হিটওয়েভ) চলছে। খুলনা বিভাগীয় জেলা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় তীব্র তাপপ্রবাহ (সিভিয়ার হিটওয়েভ) চলছে।
এছাড়া, বরিশাল বিভাগীয় জেলা এবং ঢাকা, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, বগুড়া, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, ফেনী ও বান্দরবান জেলায় মৃদু থেকে মাঝারী ধরনের তাপপ্রবাহ চলছে।
স্থবির জীবনযাত্রা
চলমান তাপপ্রবাহে সুস্থতা নিশ্চিত করতে সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নিতান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রোদের সময়টুকু বাসা থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, প্রচুর পানি পান করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তাপপ্রবাহের কারণে যানজটের শহর ঢাকায় দিনের বেলা রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা কমে এসেছে। কাঁচাবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে মানুষের উপস্থিতি কম।
সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার যানবাহনে সড়ক পরিপূর্ণ থাকলেও গতকালের চিত্র ছিল ভিন্ন। সন্ধ্যা ৬টায় রাজধানীর রোকেয়া সরণি ছিল প্রায় ফাঁকা।
মিরপুর-১২ রুটে চলা বিহঙ্গ পরিবহনের কন্ডাকটর বাবুল বেনারকে বলেন, “বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে সন্ধ্যায় গাড়িতে প্রচুর প্যাসেঞ্জার ওঠে। কিন্তু গতকাল ডেকে ডেকে প্যাসেঞ্জার পাওয়া যাচ্ছিল না। গরমে মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না।”
গরমে বেশি কষ্টে নিম্ন আয়ের মানুষ
মানুষের চলাচল কমে আসায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকটাই থমকে গেছে। ফলে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ।
রাজধানীর সবচেয়ে বড়ো পাইকারি মার্কেট কারওয়ান বাজারের আড়ত থেকে পেঁয়াজ নিয়ে ভ্যান চালিয়ে বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করেন জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার বাসিন্দা আব্দুল আজিজ।
তিনি শুক্রবার দুপুরে বেনারকে জানান, “সপ্তাহের অন্যান্য স্বাভাবিক দিনে তিনি চার থেকে পাঁচবার ভাড়া নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যান। প্রতি ট্রিপে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়।
আড়তদারদের দেখিয়ে আজিজ বলেন, “শুক্রবারে ট্রিপ বেশি থাকে, বিক্রি বেশি হয়। কিন্তু দেখেন আজ সবাই ঘুমাচ্ছে। গরমে কাস্টমার আসে না। কী করবে?”
তিনি বলেন, “আজকে ট্রিপ নেই, কাস্টমার নেই। এখন বাজে দুপুর ২টা, এখন পর্যন্ত দুটি ভাড়া পেয়েছি।”
কচুর লতি ছিলে বিক্রির আশায় বসে আছেন রহিমা বেগম। তিনি বেনারকে বলেন, “অন্যান্য দিন সকাল থেকে প্রচুর বিক্রি হয়। আজ শুক্রবার, তাও কাস্টমার নেই। দুপুর পার হয়ে গেছে, এখন পর্যন্ত দেড়শ টাকা বিক্রি হয়েছে। গরমে মানুষ বাজারে আসছে না।
“এভাবে গরম চললে আমরা বাঁচব কীভাবে! আমার সংসার আছে, সবাইকে নিয়ে চলব কীভাবে বুঝতে পারছি না,” বলেন তিনি।
আরেক খুচরা তরকারি ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ বেনারকে বলেন, “তাপপ্রবাহের ফলে গত কয়েক দিনে দেখা যাচ্ছে, সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত মানুষ বাজারে আসছেন। দিনে কাস্টমার নেই বললেই চলে।”
হাওরের কৃষকরা কষ্টেও খুশি
তীব্র গরম হলেও হাওর অঞ্চলের কৃষকরা খুশি। বৃষ্টি-বন্যা ছাড়াই ঘরে তুলতে পারছেন তাঁদের একমাত্র ফসল ধান।
কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম এলাকার কৃষক মো. হালিম বেনারকে বলেন, “রোদ আছে, কষ্ট হচ্ছে কিন্তু একদিকে ভালো—আমরা ধান কেটে ঘরে তুলতে পারছি। অনেক সময় দেখা যায়, এই সময়ে হঠাৎ বৃষ্টি ও ঢলে আমাদের ধান পানির নিচে চলে যায়।”
তিনি বলেন, “হাওরের জমি সাত মাস পানির নিচে থাকে। পানি নেমে গেলে আমরা ধান লাগাই। এই ধান দিয়েই আমাদের সারা বছরের ভাত হয়। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে কোনো কারণে যদি কৃষক ধান কাটতে না পারে, তাহলে আমাদের অনেককেই না খেয়ে থাকতে হবে। অথবা বাজার থেকে বেশি দরে চাল কিনতে হবে।”
“রোদে অনেক অসুবিধা হচ্ছে কিন্তু আমরা চাই, ধান কাটার পর যেন বৃষ্টি শুরু হয়,” বলেন হালিম।
সংকট পোল্ট্রি শিল্পে: মারা যাচ্ছে মুরগি
তাপপ্রবাহ হুমকির মুখে ফেলেছে দেশের আমিষ সরবরাহকারী অন্যতম বৃহৎ পোল্ট্রি খাত।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ পোল্ট্রি সমিতি জানায়, চলমান তাপপ্রবাহের কারণে প্রতি দিন এক লাখ মুরগি মারা যাচ্ছে। ফলে গত ১০ দিনে দেশের প্রান্তিক খামারিদের ২০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দেশে ডিম ও আমিষের সংকট দেখা দিতে পারে।
ভিন্ন চিত্র তরমুজ ব্যবসায়
গরমে ব্যবসা বেড়েছে তরমুজের। রোজায় বয়কটের ফলে যে তরমুজ ২০ টাকা কেজি পর্যন্ত নেমেছিল, সেই একই আকৃতির তরমুজ কমপক্ষে ৬০ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে।
মিরপুর এলাকার তরমুজ বিক্রেতা মো. হাফিজ শুক্রবার বেনারকে বলেন, “সবাই তো আর ডাব খেতে পারে না। একটি ডাব ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। পরিবারের সবার জন্য একটি ডাব কিনতে গেলে ব্যয় হয় ৬০০ টাকা। এতো টাকা খরচ করার সামর্থ্য সবার নেই।”
“গরমের তরমুজের বিক্রি বেড়েছে। তরমুজের সুবিধা হলো, একটি তরমুজ পরিবারের সবাই ভাগ করে খেতে পারে, সে কারণে আমাদের ব্যবসা ভালো,” যোগ করেন তিনি।