ঢাকায় হিজড়াদের টাকা আদায় বন্ধে কঠোর অবস্থানে পুলিশ

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.03.28
ঢাকা
ঢাকায় হিজড়াদের টাকা আদায় বন্ধে কঠোর অবস্থানে পুলিশ টাকা আদায়ের জন্য ঢাকার একটি রাস্তায় এক রিকশাযাত্রীর গালের চামড়া ধরে টানছেন একজন হিজড়া। ২ জানুয়ারি ২০২১।
[মো. হাসান/বেনারনিউজ]

সাংবিধানিকভাবে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি ও ভোটাধিকার পেলেও বাংলাদেশের সমাজে এখনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি হিজড়া জনগোষ্ঠী। জীবিকার জন্য অন্যের কাছে হাত পাতাই এখনো তাঁদের প্রধান অবলম্বন।

তবে টাকার জন্য উগ্র আচরণের অভিযোগ রয়েছে হিজড়াদের বিরুদ্ধে। প্রায়ই তাঁদের ঢাকার বিভিন্ন সড়ক ও ট্রাফিক সিগন্যালে টাকা চাওয়ার পাশাপাশি জোর করে টাকা আদায় করতেও দেখা যায়। টাকা না দিতে চাইলে তাঁদের হাতে হেনস্থার শিকারও হন অনেকে।

হিজড়াদের এমন আচরণকে ‘চাঁদাবাজি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে গত ২৪ মার্চ ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান ঘোষণা দেন, হিজড়ারা সড়কে ‘চাঁদাবাজি’ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মানবাধিকারকর্মীদের মতে, পুলিশের এই সিদ্ধান্ত হিজড়াদের বেঁচে থাকার পথ রুদ্ধ করবে, এতে কেউ কেউ অপরাধের পথে পা বাড়াতে পারেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র মো. ফারুক হোসেন বেনারকে বলেন, শহরের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে উত্তরা এলাকায় হিজড়ারা নগরবাসীর কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করেন। টাকা না দিলে ভয় দেখান, হয়রানি করেন, গালাগালি করেন—যা অপরাধের সামিল।

হিজড়াদের এই ধরনের কাজ বন্ধ করতে ডিএমপি কমিশনার নির্দেশ দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “পুলিশ তৎপর আছে, তাঁরা যেন রাস্তায় নেমে এগুলো করতে না পারেন। নগরবাসীর প্রতিও আহ্বান জানানো হয়েছে, কোনো হিজড়া চাঁদা দাবি করলে অথবা হয়রানি করলে তাঁরা যেন মামলা করেন।”

“উত্তরা এলাকায় হিজড়ারা সাধারণ মানুষদের হয়রানি করে টাকা আদায় করত,” বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান উত্তরা পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মুজিবুর রহমান।

তিনি বলেন, পুলিশ কমিশনারের নির্দেশনার পর উত্তরা ও এয়ারপোর্ট থানা পুলিশ সমন্বিতভাবে কাজ করছে, যাতে হিজড়ারা রাস্তায় নেমে এ ধরনের কর্মকাণ্ড না করতে পারে।

“তাঁরা এখন রাস্তায় নেই,” বলেন তিনি।

উত্তরা এলাকায় দলবদ্ধভাবে হিজড়াদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকার জন্য হইচই করার মতো ‘উৎপাত’ বেশি ছিল জানিয়ে উত্তরা সাত নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা ‍সুজাউল হক বেনারকে বলেন, পুলিশের নতুন নির্দেশনার পর “এখন কিছুটা কম।”

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেসব বাড়িতে ছোট বাচ্চা রয়েছে সেগুলোতে গিয়ে হিজড়ারা কলিং বেল টিপে টাকা চায় জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার ছেলে যখন ছোট তখন হিজড়াদের একটি গ্রুপ এসে কলিংবেল দিয়ে আমাদের কাছে টাকা চায়। ওরা এমন অবস্থা সৃষ্টি করল যে দুই হাজার টাকা দিয়ে বিদায় করতে হলো।”

“তবে তারা কোন ক্ষতি করে না। মানুষ ওদের ভয় করলে ওরা বেশি টাকা চায়। টাকা পেলে চলে যায়। কোন অস্ত্র নিয়ে আসে না। মূলত এরা বাঁচার জন্যই এই কাজগুলো করে,” বলেন ‍সুজাউল।

তাঁর মতে, হিজড়াদের “সমাজের মূল ধারায় আনতে না পারলে এধরনের সমস্যা চলতে থাকবে।”

আগারগাঁ এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী বলেন, বাস, সিএনজি বিজয় সরণি এলাকায় থামার সাথে সাথেই দুই থেকে তিনজন হিজরা একসাথে এসে বলে, “দাও, দাও, হিজরাদের টাকা দাও। না দেয়া পর্যন্ত যাবে না। অনেক সময় কেউ প্রতিবাদ করলে গালাগাল করে। তবে মারামারি করে না।”

‘চাঁদাবাজি নয়, ভিক্ষা’

পুলিশের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “হিজড়ারা যা করে সেটি চাঁদাবাজি নয়; ভিক্ষা। বাঁচার জন্য মানুষের কাছে হাত পেতে টাকা নেয়। এটিকে কোনোভাবেই চাঁদাবাজি বলা যায় না। …হয়তো তাদের কথা বলার ধরন ভালো নয়!”

তিনি বলেন, “হিজড়ারা সমাজ থেকে বিচ্যুত। কোনো দম্পতির হিজড়া সন্তান থাকলে সেই পরিবারকে সবাই এড়িয়ে চলেন। একঘরে করে দেন। তাঁদের সঙ্গে কেউ পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন করেন না। সেই কারণে পরিবার তাঁদের ঠাঁই দেয় না।”

“রাষ্ট্র কি তাঁদের পুনর্বাসন করেছে? তাঁদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করেছে? তাঁদের জন্য কতটুকু সামাজিক কল্যাণের ব্যবস্থা রয়েছে? তাঁদের প্রতি দায়িত্ব পালন না করে আইন প্রয়োগ করা অন্যায়; মানবাধিকার লঙ্ঘন,” বলেন তিনি।

“হিজড়াদের পুনর্বাসন করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। তাঁদের কিছু ভাতাও দেওয়া হয়,” বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।

“তবে সমস্যা হলো, হিজড়াদের ‘গড মাদার’। এরা অসহায় হিজড়াদের দিয়ে টাকা তোলায়, বিনিময়ে তাঁদের আশ্রয় দেয়। মূল সুবিধাভোগী হলো ওই মায়েরা। আবার অনেকে হিজড়া সেজে রাস্তায় টাকা তোলে। পুলিশ হয়তো সেই বিবেচনায় ব্যবস্থা নিচ্ছে,” বলেন তিনি।

রাশেদ খান মেননও একমত পোষণ করেন, “পুনর্বাসন করা না গেলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া একটু কঠিন। তাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। তারা আমাদেরই সন্তান।”

কোথায় যাবে তারা?

হিজড়া জনগোষ্ঠীর একজন শাম্মী ভৌমিক। তিনি সাভারে একটি বিউটি পার্লার পরিচালনা করেন।

শাম্মী বেনারকে বলেন, “হিজড়াদের সমাজ-পরিবার গ্রহণ করে না। তারা কোথায় যাবে? কী করবে? কী খাবে? ট্রাফিক পয়েন্টে, রাস্তায় ভিক্ষা করা ছাড়া তাদের আর কী করার আছে? আমি প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছি, সবার তো সেই সুযোগ নেই! তাদের লেখাপড়ার সুযোগও নেই। তারা তো ভিক্ষাই করবে!”

শাম্মী বলেন, “সরকার হিজড়াদের মাসে ৬০০ টাকা করে ভাতা দেয়, বর্তমান বাজারে যা দিয়ে দুই-তিন দিনের খাবার খরচ হয়।”

উল্লেখ্য, হিজড়াদের কেউ কেউ ভালো কাজ করেও প্রশংসিত হয়েছেন। ঢাকার বঙ্গবাজার ও কৃষি মার্কেটে আগুন লাগার পরে হিজড়া জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। এর বাইরেও বিভিন্ন সময় মানবিক কাজে তাদের এগিয়ে আসতে দেখা যায়।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় ব্লগার ওয়াশিকুরকে হত্যা করা হয়। ঘটনার পর পালানোর সময় জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে ধরে ফেলেন হিজড়া লাবণ্য। পরে আশপাশের আরও কয়েকজন হিজড়া ও স্থানীয় লোকজন দুই হত্যাকারীকে পুলিশে সোপর্দ করেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।