রাঙ্গামাটিতে বিদ্রোহী সংগঠন কুকি-চীনের হামলায় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ৩ জন নিহত
2022.06.27
ঢাকা

পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক নতুন বিদ্রোহী সংগঠন কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট সদস্যদের সশস্ত্র হামলায় এক সপ্তাহ আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তিন সদস্য নিহত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তবে স্থানীয় পুলিশ ওই হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে কিছু জানাতে পারেনি।
পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থল রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার সাজেমপাড়া, সেটি খুবই দুর্গম এলাকা। সেখানে যেতে তিন থেকে চার দিন লেগে যায়।
নিহত ব্যক্তিদের সকলেই ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে দুটি ত্রিপুরা সংগঠন।
ওই গ্রামের এক বাসিন্দা বেনারকে জানিয়েছেন, হামলায় একই পরিবারের বাবা ও ছেলে নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ওই পরিবারের দুই শিশু গুলিবিদ্ধ হয়েছে, যাদের শরীর থেকে এখনও বুলেট বের করা সম্ভব হয়নি।
ওই গ্রামের বাসিন্দা ভাগ্য মনি ত্রিপুরা সোমবার বেনারকে বলেন, ২১ জুন সন্ধ্যা ছয়টার দিকে কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সশস্ত্র সদস্যরা সাজেমপাড়ায় ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালায়।
নিহতদের পরিচয় সম্পর্কে তিনি বলেন, বিচাই চন্দ্র ত্রিপুরা (৫৫), তাঁর ছেলে বাদল চন্দ্র ত্রিপুরা (২২) এবং ওই পরিবারের সাথে বসবাসকারী ছাত্র ধনীরাম ত্রিপুরা (১৫) নিহত হয়েছেন।
ভাগ্য মনি বলেন, ওই আক্রমণে বাদল ত্রিপুরার ছেলে অনন্ত ত্রিপুরা (৪) এবং দেড় বছর বয়সের মেয়ে সুমনা ত্রিপুরা গুলিবিদ্ধ হয়েছে। অনন্ত ত্রিপুরার বুকে এবং মাথায় গুলি লেগেছে এবং সুমনা ত্রিপুরার চোয়ালে গুলি লেগেছে।
কুকি চীন সদস্যদের আক্রমণে আহত দুই শিশুকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসা তদারক করেছেন প্রতিবেশী ভাগ্য মনি ত্রিপুরা।
ভাগ্য মনি বলেন, আক্রমণের পর আহতদের প্রথমে বিলাইছড়ি এবং পরে চন্দ্রঘোনা হাসপাতালের নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা সম্ভব না হলে শুক্রবার আহত দুই শিশুকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
“শিশু দুটি খুব কষ্টে আছে। এখনও তাদের শরীর থেকে গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। আহত মেয়েটি ছটফট করছে,” বলেন তিনি।
ভাগ্য মনি বলেন, “আগে কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের নাম শুনিনি। গত কয়েকমাস ধরে এই সংগঠনটি নাম শোনা যাচ্ছে।”
ওই আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের সংগঠন বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ। হত্যাকাণ্ডের জন্য কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে দায়ী করেছে সংগঠনটি।
ওই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করার দাবি জানিয়েছে ত্রিপুরা কল্যাণ সংগঠন। একইসাথে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছে সংগঠনটি।
২৪ জুন দেয়া ওই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন সুশীল জীবন ত্রিপুরা।
ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, বাংলাদেশ এক বিবৃতিতে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে দায়ী করেছে। সংগঠনটি বলছে, আক্রমণকারীরা ২১ জুন আনুমানিক সন্ধ্যা ছয়টার দিকে নিহতদের সাইজামপাড়া গ্রামে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণ করে। ঘটনাস্থলেই তিনজন নিহত হন।
সংগঠনটি আক্রমণকারীদের আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানায়।
কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট একটি নতুন সংগঠন
পাহাড়ে কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট “একটি নতুন সংগঠন” বলে বেনারকে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
তিনি বলেন “এদের কোনো আদর্শ নেই। এরা ওই এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।”
এই সংগঠনটি পরিচালনার জন্য কোথা থেকে অর্থ পায়-এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এরা মিয়ানমারের আরাকান আর্মি এবং অন্যান্য বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে অর্থ ও সহায়তা পেয়ে থাকে।”
বাংলাদেশে মোট ৫০ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। সকল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় দুই ভাগ যাদের অধিকাংশই বসবাস করেন পার্বত্য চট্টগ্রামে।
এই ৫০ জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে বম ও ত্রিপুরা সম্প্রদায় রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদস্যরা মূলত বম জনগোষ্ঠীর এবং তাঁদের অধিকাংশই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। বাংলাদেশে বমদের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার।
সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বম বসবাস করে বাংলাদেশের সাথে সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্য মিজোরামে। বমরা দাবি করে, বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের চীন রাজ্য তাদের আদি বাস।
‘কুকি রাজ্য গঠন করতে চায়’
রাঙ্গামাটি জেলা পুলিশ সুপার মীর মোদাচ্ছের হোসেন সোমবার বেনারকে বলেন, তিনি এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জেনেছেন। তবে বিস্তারিত কিছু জানেন না।
তিনি বলেন, “কুকি-চীনের ওই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জানতে ওই এলাকায় লোক পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে এখনও খবর পাইনি। সেখানকার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সাথে কথা হয়েছে। তারাও ঘটনাস্থলে যেতে সাহস করছে না।”
তিনি বলেন, “ঘটনাস্থলটি বাংলাদেশের সাথে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সীমান্ত এলাকায়। ওই প্রত্যন্ত গ্রামে কয়েকটি পরিবার বসবাস করে।”
“কুকি-চীন বিদ্রোহীরা গত কয়েকমাস ধরে অনলাইনে কিছু ছোট ছোট ভিডিও ছেড়েছে,” জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, “সেখানে তারা বলছিল, আগামী বর্ষার সময় তারা আত্মপ্রকাশ করবে। কিন্তু কোন জায়গা থেকে কার নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করবে সেব্যাপারে কিছু জানায়নি।”
তিনি বলেন, “কুকি-চীনের ভাষ্য হলো, তারা যাঁদের আক্রমণ করেছে তাঁরা সবাই জেএসএস’র (সন্তু লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি) সদস্য এবং সেকারণেই তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে।”
জেএসএস’র সাথে যোগাযোগ করেও এব্যাপারে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “কুকি-চীন বলছে তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং আশেপাশের এলাকা নিয়ে একটি কুকি রাজ্য গঠন করতে চায়। ওই এলাকায় এরকম আরও অনেক গোষ্ঠী রয়েছে যারা বিভিন্ন রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলে নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে।”