অনুমোদনহীন ও নিম্নমানের ৭০০’র বেশি হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধ
2024.02.01
ঢাকা
সম্প্রতি ঢাকায় একটি লাইসেন্সবিহীন হাসপাতালে খতনা করার সময় এক শিশুর মৃত্যুর পর গত দুই সপ্তায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে সাত শতাধিক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
নতুন সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন দেশজুড়ে অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশ দেবার পর গত ১৫ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনিবন্ধিত সব হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের তথ্য চেয়ে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ও সিভিল সার্জনদের চিঠি পাঠায়।
প্রায় একই সময়ে হাইকোর্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশ দেয়।
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, সারা দেশে লাইসেন্সহীন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের তালিকা তৈরি করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান।
এ পর্যন্ত সারা দেশে এক হাজারের বেশি ‘অনুমোদনহীন, নিম্নমানের’ হাসপাতালের তালিকা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এর মধ্যে সারা দেশে ৭২৭টি অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক ও ব্লাড ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
বন্ধ করে দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান কখনো লাইসেন্স করেনি বলেও জানান ডা. আবু হোসেন।
তিনি বলেন, “অনেক ক্লিনিক আছে যেগুলোকে পাঁচ বছর আগে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে তারা আর লাইসেন্স নবায়ন করায়নি। কিছু ক্লিনিক আছে যেগুলো আমাদের নীতিমালার শর্ত একেবারেই পূরণ করতে পারেনি। সে কারণে সেগুলো মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
গত ২৬ জানুয়ারি ভাটারা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড নার্সিং ইনস্টিটিউট নামে একটি বেসরকারি হাসপাতাল বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তাঁর হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়।
“এখন আমরা লাইসেন্স নবায়ন করে হাসপাতালটি আবার চালু করার চেষ্টা করছি। আমাদের অন্য কোনো সমস্যা নেই,” বলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার গুলশান এলাকায় লাইসেন্সহীন ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে খতনা করার জন্য অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর সাড়ে পাঁচ বছর বয়েসী শিশু আয়ান আহমেদের আর জ্ঞান ফিরে আসেনি।
ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় ছেলের মৃত্যু হয়েছে অভিযোগ করে হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা করেন আয়ানের বাবা শামীম আহমেদ। মৃত্যুর পর দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।
সর্বাধিক অবৈধ প্রতিষ্ঠান খুলনায়
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত ১৫ থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত খুলনায় ১০৫টি হাসপাতাল, ১৩৯টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ৭৪টি ব্লাড ব্যাংক বন্ধ করা হয়েছে।
ঢাকায় বন্ধ করা হয়েছে ৭০টি হাসপাতাল, ৪০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ১০টি ব্লাড ব্যাংক। বাকিগুলো অন্য বিভাগের।
কোনো প্রকার লাইসেন্স না নিয়ে হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিচালনা করা “একদিকে যেমন প্রতারণা” অন্যদিকে তেমনি এতে “সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর।
লোকবল সংকটের কারণে হাসপাতাল তদারকি করা “কিছুটা কঠিন” হলেও অধিদপ্তর নিয়মিত অভিযানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
স্বাস্থ্য খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) তথ্য অনুসারে, দেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগই বেসরকারি খাতের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা ১৫ হাজার ১৪৩টি।
এর মধ্যে হাসপাতাল চার হাজার ৯৯৩টি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার নয় হাজার ৯৯৫টি ও ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা ১৯৪টি।
প্রয়োজন নিয়মিত তদারকি
কোনো একটি দুর্ঘটনার পরে দেশজুড়ে হইচই শুরু হলে তার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযান চালিয়ে কিছু হাসপাতাল ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে সাময়িকভাবে মানুষের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া গেলেও নিয়মিত তদারকি না থাকলে এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহাবুব বেনারকে বলেন, “এসব অভিযান চালানো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসব করতে গেলে তাদের মূল কাজ বিঘ্নিত হবে।”
জেলায় জেলায় কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলার তাগিদ দিয়ে এই স্বাস্থ্য অধিকারকর্মী বলেন, “একটি অধিদপ্তর বা পরিদপ্তর গঠন করে তার অধীনে এসব কাজ করতে হবে।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নাজমুল হোসাইন বেনারকে বলেন, “এসব অভিযান কিছু দিন পরপরই হয় কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। বন্ধ হয়ে যাওয়া কোনো প্রতিষ্ঠান যেন আবারও অবৈধভাবে কার্যক্রম চালাতে না পারে, সে জন্য বছরজুড়ে তদারকি প্রয়োজন।”
রশিদ ই মাহাবুবের একাত্মতা পোষণ করে তিনি বলেন, আলাদা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এই তদারকি করা গেলে কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা যাবে।
বাংলাদেশ বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক মালিক সমিতির সভাপতি মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া বেনারকে বলেন, “সরকার স্থায়ীভাবে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় কিছু দিন পরপর অভিযান চালাতে হয়। এতে সার্বিকভাবে বেসরকারি খাতের সুনাম নষ্ট হয়।
“আমরা চাই অবৈধ হাসপাতাল ক্লিনিক নিয়মিত নজরদারিতে থাকুক, যাতে করে কিছু দিন পরপর এসব অভিযান করতে না হয়। তবে এসব অভিযানের মারাত্মক নেতিবাচক দিকও আছে,” যোগ করেন তিনি।