রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে ‘মাত্রাতিরিক্ত কঠোর পদক্ষেপ’ নিচ্ছে সরকার: আইসিজে

কামরান রেজা চৌধুরী ও সুনীল বড়ুয়া
2019.12.27
ঢাকা ও কক্সবাজার
রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে ‘মাত্রাতিরিক্ত কঠোর  পদক্ষেপ’ নিচ্ছে সরকার: আইসিজে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে কাটাতারের বেড়া। তারিখ- ৯ ডিসেম্বর ২০১৯
ছবি- সুনীল বড়ুয়া।

রোহিঙ্গাদের চলাচল ও যোগাযোগ সীমিত করতে সরকারের ‘মাত্রাতিরিক্ত কঠোর পদক্ষেপ’ বাংলাদেশে নিরাপত্তাহীনতা ও সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ।

শুক্রবার প্রকাশিত বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনে এই শঙ্কার কথা জানানো হয়।

বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজে) প্রতিবেদনে এবং রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার পরিকল্পনা পরিহার করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তাদের ভাষায়, এই পরিকল্পনা বাংলাদেশের জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রত্যাবাসনকে মাথায় রেখে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে মিলে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ আবাসন, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত বাংলাদেশের সরকারের। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া স্থানীয় জনগণকেও সরকারের সহায়তা করা উচিত।

তবে প্রতিবেদনের ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাচল, শিক্ষা, চাকরিসহ অন্যান্য সেবা নিশ্চিত করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়।

আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে জানিয়েছেন, শরণার্থীরা পৃথিবীর কোনো দেশে অবাধে চলাচল করতে পারে না। রোহিঙ্গাদের স্বার্থেই তাদের শরণার্থীশিবিরে রাখা হবে বলে তিনি জানান।

প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা সফল হচ্ছে না

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১১ লাখ রোহিঙ্গার ক্যাম্পে অবস্থানকে ‘স্বল্প মেয়াদি চ্যালেঞ্জ’ মনে করে তাদের প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ। তারা দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা করছে না। এদিকে বাংলাদেশের প্রত্যাবাসন পরিকল্পনাও সফল হচ্ছে না।

এ বছর আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চলাচলে ও তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারে এবং ক্যাম্পে কর্মরত বেসরকারি সংস্থার কাজের ওপর ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে সরকার। একই সাথে শরণার্থীশিবিরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ ও নজরদারির জন্য ক্যামেরা স্থাপন করা হচ্ছে।

ভাসানচরে ঝুঁকির আশঙ্কা

প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ ভাসানচরে সরিয়ে নিতে সরকারের পরিকল্পনার সাথে ঝুঁকি রয়েছে। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অপরাধ কর্মকাণ্ড ও চরমপন্থার পথ বেছে নিতে পারে। যার ফলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলো জটিল করে তুলবে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, “আমরা কয়েক বছরের পরিকল্পনা করিনি। এর কারণ হলো বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গাদের এখানে রাখার কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। যত দ্রুত সম্ভব আমরা তাদের প্রত্যাবসিত করতে চাই। ”

তিনি বলেন, “আমরা মিয়ানমারের সাথে কূটনৈতিকভাবে যুক্ত আছি। এবং আমি আশা করি মিয়ানমার তাদের ফিরিয়ে নেবে। ”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “রোহিঙ্গাদের অন্যকোনো দেশ যেখানে তারা ভালো চলাচলের সুযোগ, ভালো শিক্ষা ও ভালো চাকরির সুযোগ পাবে সেখানে নিয়ে যেতে আমাদের সহায়তা করতে পারে আন্তর্জাতিক সংকট গ্রুপ। আমরা এখানে তাদের এগুলো দিতে পারব না। ”

বাংলাদেশিদের মতো স্বাধীনতা রোহিঙ্গারা পাবে না

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা শরণার্থী এবং মিয়ানমারের নাগরিক। আমরা তাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছি। সুতরাং তারা বাংলাদেশিদের মতো স্বাধীনতা চাইলে তো পাবে না। তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবে না। ”

তিনি বলেন, “পৃথিবী সব জায়গায় শরণার্থীদের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়। সিরিয়ায় দেখুন, ক্যাম্প থেকে পালিয়ে শরণার্থীরা বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষা করছে। আমরা চাই না রোহিঙ্গারা ভিক্ষা করুক। তারা ক্যাম্পে খাদ্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাচ্ছে। ”

মন্ত্রী বলেন, “রোহিঙ্গাদের একটি অংশ হত্যা, মাদক চোরাচালান, মানব পাচার, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের অপরাধী কর্মকাণ্ড দিন দিন বাড়ছে। ”

“কাজেই, সাধারণ রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে ও অপরাধ কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে তাদের ক্যাম্পের মধ্যে রাখা প্রয়োজন, ” বলেন তিনি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “তাদের অবাধে চলাচল করতে দিলে তারা সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে, সারা দেশে অপরাধ কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটবে। আমার তা হতে দিতে পারি না। ”

তিনি বলেন, “চরমপন্থীরা রোহিঙ্গাদের জঙ্গিবাদের সাথে জড়ানোর চেষ্টা করবে। সে জন্যই তাদের ওপর নজরদারি প্রয়োজন। আমরা বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড বরদাশত করব না। ”

আসাদুজ্জামান খান বলেন, “১২ লাখ রোহিঙ্গার চাপে উখিয়া, টেকনাফ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সেখানে কিছুটা চাপ কমাতে আমরা এক লাখ রোহিঙ্গাকে নিরাপদ ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছি। সেখানে কর্ম, শিক্ষা, নিরাপদ বাসস্থানের সুযোগ থাকলেও তারা সেখানেও যাবে না। ”

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য কর্নেল ফারুক খান বেনারকে বলেন, “আমরা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভায় সরকারকে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের সুপারিশ করি। কাঁটাতারের বেড়া অপরাধী কর্মকাণ্ড থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করবে। ”

তিনি বলেন, “সেনাবাহিনী কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করবে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ওপর নজর রাখবে। ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। ”

রোহিঙ্গারা যা বলছেন

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সেক্রেটারি মো. ছৈয়দ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “সরকার আমাদের আশ্রয় দিয়েছে এটার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। তবে আমরা লক্ষ করছি, রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে সরকারের তৎপরতা আগের চেয়ে বেড়েছে। ক্যাম্পে কাঁটাতারের বেড়া হচ্ছে। ”

তিনি বলেন, “তবে আমি বলব জোর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। জোর করে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেয়ে রোহিঙ্গাদের যদি বোঝানো যায়, এটা ভালো। তাতেই ফল বেশি আসবে। ”

টেকনাফ শালবন রোহিঙ্গা শিবিরের মাঝি বদরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদারকি বাড়ানো হয়েছে। কিছু রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। সরকারের সব ধরনের প্রস্তুতি আমাদের চোখে পড়ছে। ”

তিনি বলেন, “কারণ ক্যাম্পেও কিছু কিছু অপরাধ হচ্ছে সেটা আমরা দেখছি। ”

বদরুল বলেন, “বর্তমানে ক্যাম্পে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা চালু রয়েছে। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, মিয়ানমার কারিকুলামে রোহিঙ্গা শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানের জন্য। কারণ মিয়ানমার ফিরে গেলে এরা যেন এসব শিক্ষা কাজে লাগাতে পারে। ”

কুতুপালং ক্যাম্প-৪ এর হেড মাঝি মো. আব্দুর রহিম বেনারকে বলেন, “আমরা কোনোভাবেই সরকারের সঙ্গে বিরোধে জড়াতে চাই না। এ সরকার আমাদের যেভাবে রাখবে, সেভাবেই আমাদের এখানে থাকতে হবে। এমনকি সরকারের ক্ষতি হবে এ রকম কোনো কর্মকাণ্ড থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। ”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।