তাবলিগের সাদ-জুবায়ের সমর্থকদের সংঘর্ষ, চার মুসল্লি নিহত

জিয়া চৌধুরী
2024.12.18
ঢাকা
তাবলিগের সাদ-জুবায়ের সমর্থকদের সংঘর্ষ, চার মুসল্লি নিহত গাজীপুরে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠের দৃশ্য। ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪।
[সনি রামানী/বেনারনিউজ]।

টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাবলিগ জামাতের  দুই পক্ষের অনুসারীদের তুমুল সংঘর্ষে চারজন নিহত হওয়ার পর ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী গাজীপুর জেলায় বুধবার দিনভর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঢাকা ও গাজীপুরে মসজিদ, হাসপাতাল ও ইজতেমা ময়দানসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু এলাকায় পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।

গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ইজতেমার মাঠ ও আশপাশের তিন কিলোমিটারের মধ্যে সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. জাহিদুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “দুই পক্ষকেই মাঠ ছাড়তে বলা হয়েছে। ময়দান ও আশেপাশে কোনো জমায়েত করা বা মাইক ব্যবহার করা যাবে না।”

এদিকে তুরাগ নদীর দক্ষিন-পশ্চিম পাড়ের ঢাকা মহানগর এলাকার মধ্যে ১৮ ডিসেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত যে কোনও ধরনের সভা-সমাবেশ বা জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।

বুধবার বিকাল থেকে ইজতেমা ময়দান ছাড়তে শুরু করেন মুসল্লিরা।  

নিহত চার, আহত ৫০: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

বিশ্ব ইজতেমার মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে মাওলানা জুবায়ের আহমেদ ও মাওলানা সাদ কান্ধল‌ভি’র অনুসা‌রীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছেন বলে জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

বুধবার সচিবালয়ে এক জরুরি বৈঠক শেষে তিনি বলেন, সংঘর্ষে চারজন নিহতের পাশাপাশি অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন।

“হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।  কোনও ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই,” জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।

সংঘর্ষে নিহতরা হলেন; কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার আমিনুল হক (৭০), ও বাচ্চু মিয়া (৭০), বগুড়ার তাজুল ইসলাম (৬৫) ও ঢাকার দক্ষিণখানের বেরাইদ এলাকার মো. বেলাল (৬০)।

মাঠ ছেড়েছে দুই পক্ষ

বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জরুরি বৈঠক শেষে মাওলানা সাদের অনুসারী রেজা আরিফ সাংবাদিকদের বলেন, মাঠের দখল নিয়ে দু'পক্ষের মধ্যে আর কোন হানাহানি তারা চান না।  নিরাপত্তার স্বার্থে তারা ইজতেমা বুধবার বিকাল থেকেই মাঠ ছেড়ে যাচ্ছেন।  

"আমরা অন্য পক্ষকেও (জুবায়েরপন্থী) শান্তিপূর্ণভাবে মাঠ ছেড়ে যাওয়ার অনুরোধ করবো।  কেউ যাতে কোনও ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য না দেয়, ফেসবুক লাইভে না যায়।  মুসলমান-মুসলমান মারামারি এটা একেবারেই ঠিক হয়নি,” রেজা আরিফ যোগ করেন।

জুবায়েরপন্থী গ্রুপের গণমাধ্যম সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ বেনারকে বলেন, “সাদপন্থী অনুসারীরা অন্যায়ভাবে আমাদের অনুসারীদের ওপর হামলা চালিয়েছে।  বিকেলে সেনাবাহিনী মাঠের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তাদের এক প্রকার জোর করে বের করে দেয়া হয়েছে।” 

টঙ্গীর জের ঢাকাতেও

এর আগে ইজতেমা ময়দানে দুই পক্ষের দখল নিয়ে উত্তেজনার ছড়ায় রাজধানী ঢাকাতেও।  সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুই পক্ষের অনুসারীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে বলে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক।

এমন পরিস্থিতিতে তাবলিগ জামায়াতের কেন্দ্রস্থল রাজধানীর কাকরাইল মসজিদ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পাশাপাশি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী।

বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, তাবলিগ জামাতের দুপক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় টঙ্গীতে চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

ঘটনা যেভাবে শুরু

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে গাজীপুরের টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।

রাত তিনটার দিকে সাদপন্থীরা ইজতেমা মাঠে প্রবেশ করতে থাকেন। এসময় মাঠের ভেতর থেকে জুবায়েরপন্থীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন।  সাদপন্থীরা মাঠে প্রবেশ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়।

 

2d21f2be-62ae-44a4-8dd2-07229541917b.jpeg
গাজীপুরে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠের দখল নিয়ে মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদ কান্ধলভি’র অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর ফাঁকা মাঠে লাঠি হাতে কয়েকজন মুসল্লি। ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪। [সনি রামানী/বেনারনিউজ]।

যে কারণে বিভক্তি

২০১৮ সালে তাবলিগের বর্তমান আমির ভারতের দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে আমির মানা না-মানাকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে পড়ে তাবলিগ জামাত।  ওই বছর ইজতেমায় অংশ নিতে বাংলাদেশে এসে বিরোধের মুখে ফিরে যান সাদ কান্ধলভি।

দুই পক্ষের বিরোধে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তুরাগ ময়দানে সংঘর্ষে নিহত হন এক মুসল্লি।  এরপর ২০১৯ সাল থেকে দুই পক্ষ আলাদাভাবে ইজতেমা শুরু করে। মাঝে কোভিড মহামারির কারণে ইজতেমা দুই বছর বন্ধ থাকে।  ২০২২ সাল থেকে ফের ইজতেমা হচ্ছে দুই পর্বের আয়োজনে।  

এবারও টঙ্গীর তুরাগ তীরে দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।প্রথম পর্বে ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি ইজতেমায় অংশ নিবেন ‘জুবায়েরপন্থীরা’ এবং দ্বিতীয় পর্বে ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি অংশ নিবেন ‘সাদপন্থীরা’।

বিশ্ব ইজতেমার আগে গত ২৯ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে ৫ দিনের জোড় ইজতেমা পালন করেন কাকরাইল মারকাজের মাওলানা জুবায়ের অনুসারীরা।  এরপর ইজতেমা মাঠে ২০ ডিসেম্বর থেকে ৫ দিনের জোড় ইজতেমা পালনের ঘোষণা দেন দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীরা।

তবে সাদের অনুসারীদের জোড় ইজতেমা করতে না দেওয়ার দাবিতে ১৩ ডিসেম্বর টঙ্গী-কালীগঞ্জ আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছিল মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা।  

জোড় ইজতেমার জন্য মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার মধ্যরাতে মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদের অনুসারিরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।

ঢাকার দারুল উলুম হামিদিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও কাকরাইল মসজিদের মুরুব্বি মাওলানা শাহরিয়ার মাহমুদ বেনারকে বলেন, তাবলিগ জামাতের দ্বন্দ্ব মূলত একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে, তিনি দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভি। ভারতের মাওলানা-মুরব্বিরা যাদের কাছ থেকে তিনি (সাদ) ধর্মীয় জ্ঞান নিয়েছেন তারাও তাকে নানা অভিযোগে ২০১৫ সালের পর থেকে বয়কট করেছেন।

“বাংলাদেশে তার কিছু অন্ধ অনুসারী ধর্মকে পাশ কাটিয়ে ব্যক্তির দিকে নজর দিয়েছেন। ইসলাম এই ব্যক্তিতুষ্টির চেয়ে শান্তির কথাই বেশি বলে।  তাই ইসলামকে মেনে নিলে এত বিভক্তি-হানাহানি থাকে না,” বলেন শাহরিয়ার মাহমুদ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।