ঋণের সঙ্গে বিদ্যুতের দাম বাড়ার সম্পর্ক দেখছেন ব্যবসায়ীরা
2023.01.31
ঢাকা
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সোমবার ঋণ অনুমোদন দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বাংলাদেশে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বেড়েছে। ব্যবসায়ী নেতারা বিদ্যুৎ ও গ্যাসের এই ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে আইএমএফের শর্ত রয়েছে বলে মনে করছেন।
এর ১২ দিন আগে শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় সর্বোচ্চ প্রায় তিনগুণ। এ ছাড়া চলতি মাসের ১০ তারিখে বাড়ানো হয়েছিল বিদ্যুতের দাম।
“আইএমএফের শর্ত পালন করতে গিয়ে” বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছে বলে মনে করেন নিটওয়্যার পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
তিনি বেনারকে বলেন, “এতে উৎপাদন খরচ আরো বাড়বে এবং বিশ্ববাজারে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাবে।”
তাঁর মতে, এর ফলে রপ্তানির মাধ্যমে যে ডলার আসার সুযোগ ছিল, তা হবে না।
দেশে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বেনারকে বলেন, “বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, প্রতি মাসেই বিদ্যুতের দাম সমন্বয় হবে। তার মানে আসলে দাম বাড়বে। এভাবে বাড়তে থাকলে পণ্যমূল্য বাড়বে, যার চাপ যাবে ভোক্তার উপর।”
উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ১০ জানুয়ারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসার পর বলেছিলেন, প্রতি মাসে এই দাম সমন্বয় করা হবে।
যদিও আইএমএফের বিজ্ঞপ্তিতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বা সংস্কারের শর্তের বিষয়ে সরাসরি কিছু বলা নেই। তবে বাংলাদেশে সফরকারী সংস্থাটির মিশন প্রধান রাহুল আনন্দের এফএকিউ-তে (ফ্রিকোয়েন্টলি আস্কড কোশ্চেন) ভর্তুকি কমানোর যুক্তি দেওয়া হয়েছে।
কেন আইএমএফ ভর্তুকি বাতিল করতে বলছে, যা দরিদ্রদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করবে–এমন এক প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়, “সব ভর্তুকি দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণদের সাহায্য করে না। বাংলাদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, আবার ধনীরা বেশি গাড়ি চালায় এবং বেশি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে।”
যদিও অর্থনীতিবিদ এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ভর্তুকি কমাতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পক্ষে।
“বর্তমানে সরকারের ভর্তুকি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এটা সরকারের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। এই ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে,” বেনারকে বলেন ড. মনসুর।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চাপ সামাল দিতে বৈশ্বিক ঋণদানকারী সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে বহুল আলোচিত সাড়ে চারশো কোটি ডলারের বেশি (প্রায় ৪৭০ কোটি ডলার) ঋণের অনুমোদন মিলেছে। এই ঋণের ৪৭ কোটি ৬০ লাখ শিগগিরই ছাড় হবে, আর পুরো ঋণের অর্থ ছাড় হবে আগামী সাড়ে তিন বছরের মধ্যে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়ক হবে
সোমবার আইএমএফের ওয়াশিংটন অফিসে নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের এ ঋণ অনুমোদন হয়েছে বলে সংস্থাটির এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, “ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে কোভিড মহামারি পরবর্তী বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি, টাকার অবমূল্যায়ন এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেয়েছে।”
এই কর্মসূচি (ঋণ) শক্তিশালী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং পরিবেশগতভাবে টেকসই প্রবৃদ্ধির ভিত্তি স্থাপনের পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে সহায়ক হবে বলে জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
এ ঋণ অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ আইএমএফকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এক বিবৃতিতে বলেন, “এ ঋণ অনুমোদনের মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হলো যে, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাসমূহ শক্ত ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে আছ এবং অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো।”
এ বিষয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “ঋণের অর্থ দিয়ে হয়ত বিদ্যমান অর্থনৈতিক সমস্যার সামান্য কিছু সমাধান হবে। বাকিটা পলিসি দিয়ে। যেমন আর্থিক খাতের সংস্কার, বাজেটের ডেফিসিট, রিজার্ভ নির্দিষ্ট লেভেলের উপরে বা নিচে যাবে না – এমন কিছু।”
বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সম্প্রসারিত ঋণ সুবিধা (ইসিএফ) ও সম্প্রসারিত তহবিল সুবিধার (ইএফএফ) আওতায় আইএমএফ বাংলাদেশকে ৩৩০ কোটি ডলার এবং রেজিলিয়েন্স ও সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) এর আওতায় দিচ্ছে ১৪০ কোটি ডলারের ঋণ।
আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের সভা শেষে এক বিবৃতিতে সংস্থাটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এন্তোনিও এম সায়েহ এই ঋণ বাংলাদেশের সংস্কার কর্মসূচিকে এগিয়ে নেবে বলে আশার কথা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “ইসিএফ ও ইএফএফ ব্যবস্থা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করবে এবং কর্তৃপক্ষের সংস্কার এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।”
সংস্কারে সরকারের অগ্রগতি কতটুকু
আইএমএফের ডিএমডি এন্তোনিও এম সায়েহ বিবৃতিতে কিছু সংস্কারের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, “সরকারি অর্থায়ন, বিনিয়োগ এবং ঋণের ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করার জন্য আর্থিক সংস্কার ব্যয় দক্ষতা, সুশাসন এবং স্বচ্ছতা উন্নত করবে।”
আর্থিক খাতের ঝুঁকি কমানো, তদারকি জোরদার করা, সুশাসন ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো উন্নত করা এবং পুঁজিবাজারের উন্নয়ন-প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে অর্থ যোগানের ক্ষেত্রে সহায়তা করবে বলেও মনে করেন তিনি।
বাণিজ্য এবং বিদেশি বিনিয়োগ সম্প্রসারণে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার জন্য কাঠামোগত সংস্কার, আর্থিক খাতকে বিস্তৃত করা, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং ব্যবসায়িক পরিবেশ বাড়ানোর মত বিষয়ও গুরুত্ব পেয়েছে।
সরকার ইতিমধ্যে রিজার্ভ থেকে ইডিএফ ছোট করে রিজার্ভ বড়ো করার উদ্যোগ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে এক বিলিয়ন ডলার রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) রিজার্ভ সমন্বয় করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সোমবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “রিজার্ভ থেকে আপাতত আর কোনো তহবিল গঠন করা হবে না। এ ছাড়া ইডিএফ থেকে দেওয়া অর্থ সমন্বয় করে এর (ইডিএফ এর) আকার ধীরে ধীরে কমানো হবে।”
গত নভেম্বরে আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানিয়েছিলেন, বর্তমান রিজার্ভ থেকে ইডিএফ এবং অন্যান্য ফান্ড বাদ দিলে নিট রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় আট বিলিয়ন ডলার কমবে।
দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার পর অনেকটা তড়িঘড়ি করে নতুন আয়কর আইন মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। শিল্পোদ্যোক্তারা ধারণা করছেন, ভবিষ্যতেও বাড়বে।
অবশ্য দেশের ব্যাংক খাতে বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও সেখানে কার্যকর কোনো সংস্কার এখনো দেখা যায়নি। ব্যাংক খাতে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ এক লাখ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
মুদ্রার বিনিময় হার এখনো বাজারভিত্তিক করা হয়নি। ব্যাংক সূদের হারের সীমাও বাজারভিত্তিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। রাজস্ব খাতে সংস্কারের বিস্তর আলোচনা হলেও রাজস্ব আদায়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার এখনও হয়নি।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আইএমএফ চায় বলে নয়, নিজেদের তাগিদেই এসব সংস্কার করতে হবে।”
কোভিড পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার মধ্যেই গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর পরবর্তী মাসগুলোতেও মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরেই থাকছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে ৪৬ বিলিয়ন ডলার থেকে গত ডিসেম্বরে রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। এর মধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) এর অংশ বাদ দিলে নিট রিজার্ভ আরো সাত থেকে আট বিলিয়ন ডলার কমে যাবে। রপ্তানি আয় বাড়ছে, তবে প্রবাসী আয় আগের বছরের তুলনায় কমেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজস্ব আদায় একেবারে তলানিতে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে রাজস্বের অবদান (ট্যাক্স টু জিডিপি অনুপাত) ৮ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় সর্বনিম্ন।
সরকার চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরুতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাক্কলন করলেও আইএমএফ বলছে এটি হবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক এই প্রাক্কলন আরো কমিয়েছে।
গত বছরের ২৪ জুলাই ঋণ চেয়ে আইএমএফের কাছে চিঠি দেয় বাংলাদেশ। ঋণ বিষয়ে আলোচনা করতে আইএমএফের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে সংস্থাটির প্রতিনিধিদল গত ২৬ অক্টোবর ঢাকায় আসে এবং ঋণের বিষয়ে সবুজ সংকেত দেয়।
গত জানুয়ারির ১৬ তারিখে ঢাকা সফররত আইএমএফ এর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এন্তোনিও এম সায়েহ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী সহ অন্যান্য পক্ষগুলোর সঙ্গে বৈঠক শেষে এক বিবৃতিতে ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের ঋণ আবেদন অনুমোদনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়েছিলেন।