সম্পর্কের মেঘ কেটে যাবে বলে বাংলাদেশ-ভারতের আশাবাদ
2024.12.09
ঢাকা
ভারতের মূল বার্তা হচ্ছে, তারা গঠনমূলক ও ইতিবাচক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। একদিনের সফরে ঢাকায় এসে সে কথা জানিয়ে গেলেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি।
অন্যদিকে ভারতে অবস্থানরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বক্তব্য অন্তর্বর্তী সরকার পছন্দ করছে না-সেই বার্তা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।
দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশি দেশ ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সর্ম্পকের সাম্প্রতিক টানাপোড়েন 'ট্রাস্ট গ্যাপ' বা বিশ্বাসের সংকট থেকে সৃষ্টি বলে মনে করে বাংলাদেশ। তবে, দুই পররাষ্ট্র সচিবের আলোচনার পর গত কয়েকদিন ধরে চলা উত্তেজনাকর পরিস্থিতি ইতিবাচক পথে এগোবে এবং সম্পর্কের মেঘ কেটে যাবে বলে প্রত্যাশা দুই দেশের।
সোমবার ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির প্রথম বাংলাদেশ সফরে কয়েকদফা বৈঠক করেন সরকারের নীতি নির্ধারকের সঙ্গে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে এটাই প্রথম উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ফরেন অফিস কনসালটেশন বা এফওসিতে অংশ নিতে এ দিন সকালে কয়েক ঘণ্টার সফরে ঢাকা আসেন বিক্রম।
ঢাকায় এসে সোমবার দুপুরে পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিনের সাথে সচিব পর্যায়ের বৈঠক ছাড়াও অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গেও। দিনভর ব্যস্ততা শেষে সোমবার রাতেই দিল্লি ফিরে যান তিনি।
তার আগে রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘অপপ্রচারের জবাব লিখিত ও মৌখিক—বহুভাবেই বলেছি, যতগুলো ঘটনা ঘটেছে সেগুলোকে সাম্প্রদায়িক দেখানোর সুযোগ খুবই কম। সেগুলো কখনো কখনো ব্যক্তিগত, বেশির ভাগই রাজনৈতিক।
“আমাদের স্পষ্ট অবস্থান হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার না এটির অংশ, না এটি কোনোভাবেই বরদাশত করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সচিবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন কারণে যে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে একটি মেঘ এসেছে, এই মেঘটি দূর করতে হবে। আমরাও বলেছি, এই মেঘটি দূর করতে হবে,” বলেন উপদেষ্টা।
সংখ্যালঘু বিষয়ে গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গির আহবান ভারতের
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ভারত ‘গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি’ প্রত্যাশা করে বলে জানান ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক কিছু বিষয় ও ঘটনা নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনার সুযোগ হয়েছিল। আমি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে ভারত সরকারের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছি।”
তাঁর দেশ মানুষকে কেন্দ্রে রেখে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়-উল্লেখ করে বিক্রম বলেন, “দুই দেশের জনগণের স্বার্থে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে আগ্রহী ভারত। ”
তবে সোমবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র ভবনে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “আমরা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে কথা বলি না, বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে কোন দেশ নাক গলাক তাও চাই না। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রিকে বৈঠকে এমন বার্তাই দেয়া হয়েছে।”
“একই সাথে ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের যেসব 'অপতথ্য' ছড়ানো হচ্ছে ভারতকে সে বিষয়েও জানানো হয়েছে,” বলেন পররাষ্ট্র সচিব।
জসিম উদ্দিন বলেন, "আমরা আশা করছি, ভারত অপতথ্যের বিপরীতে ইতিবাচক ধারণা নিয়ে ফিরে গেছে। তিনি (ভারতের পররাষ্ট্র সচিব) নিশ্চয়ই তাঁর দেশের গণমাধ্যমকে বিষয়গুলো অবহিত করবেন। "
অন্যদিকে বিক্রম মিশ্রি সাংবাদিকদের বলেন, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও কূটনৈতিক কিছু সম্পত্তির ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে, এগুলো অত্যন্ত দুঃখজনক।
তিনি বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁকে প্রথম শুভেচ্ছা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদি বলেছিলেন, ভারত চায় সামনে এগোনোর মতো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক।
তিনি বলেন, পরে তাঁদের দুজনের মধ্যে (ইউনূস-মোদি) আন্তরিক ফোনালাপ হয়েছে, যার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ‘থার্ড ভয়েস অব দ্য গ্লোবাল সাউথ সামিট' শীর্ষক সম্মেলনে বক্তব্য প্রদান করেন, যা এ বছরের আগস্টে অনুষ্ঠিত হয়। তখন থেকে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবরা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ বজায় রেখেছেন।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ সম্মেলনের ফাঁকে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, এসব আলোচনার ভিত্তিতে আমার এবারের সফর, যা উভয় পক্ষের মধ্যে বৈদেশিক পর্যায়ের কাঠামোগত একটি আলোচনার প্রথম প্রয়াস।
উত্তর মেলেনি হাসিনার ভারতে অবস্থান বিষয়ে
দেশ ছেড়ে ভারতে অবস্থান নেয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন স্ট্যাটাসে ভারতে আছেন, কিংবা তার অবস্থানই বা কোথায় সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে খোলাসা করে উত্তর মেলেনি কারো কাছেই।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, “ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন তাঁর (হাসিনার) ভারতে অবস্থান আমাদের সর্ম্পকে প্রভাব ফেলবে না। তারা এখনকার সরকারের সাথে সর্ম্পক উন্নয়নে আগ্রহী।"
জসিম উদ্দিন আরো বলেছেন, ‘‘ভারতকে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা ভারত থেকে যে বক্তব্যগুলো দিচ্ছে তা বাংলাদেশ পছন্দ করছে না। সেটা তাকে জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে। তিনি সেটা নোট নিয়েছেন।''
তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার বিষয়ে ভারতকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে কিনা-সেই প্রশ্নের উত্তর দেননি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ‘ট্রাস্টের ঘাটতি’ আছে উল্লেখ করে জসীম উদ্দিন বলেন, ট্রাস্টের একটা ঘাটতি ছিলো বলেই আমাদের এই প্রক্রিয়া অতিক্রম করতে হচ্ছে। সেটার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আজকের এই বৈঠক।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘‘বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নবায়ন করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশকে বন্যার পূর্বাভাস জানাতে হবে। পণ্য আমদানি-রপ্তানি নিরবচ্ছিন্ন করার আহ্বানও জানানো হয়েছে। নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আনার বিষয়েও তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। একইসঙ্গে ভিসা প্রাপ্তি সহজ করতে বলা হয়েছে।’’
ইতিবাচক বলছেন বিশ্লেষকেরা
দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়নের মধ্যে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বেনারনিউজকে বলেন, “বৈঠক শেষে ভিসাসহ অনান্য বিষয়ে দৃশ্যমান কোনও প্রতিশ্রুতি না আসলেও সাম্প্রতিক আবহ দেখে বৈঠক ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে বলে আমার মনে হয়। দুই দেশই সর্ম্পক এগিয়ে নিতে চায় বলে মনে হয়েছে। ভারতও তাদের দিক থেকে ‘পিপল টু পিপল’ সর্ম্পকের কথা বলেছে, তবে এমন প্রতিশ্রুতি সামনের দিনগুলোতে বাস্তবায়ন কতটুকু হয় সেটা এখন দেখার বিষয়।"
“বৈঠক শেষে মনে হয়েছে, উভয় দেশেরই সর্ম্পক উন্নয়নে সদিচ্ছা বা আগ্রহ আছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ, শেখ হাসিনার অবস্থান ও বক্তব্য ও অনান্য বিষয় নিয়ে এর আগেও কথা হয়েছে। তবে ভারতও আগ্রহ ও উদ্বেগের (সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়) কথা জানিয়ে গেছে। আমাদের সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে,” যোগ করেন তিনি।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার গত দুই সপ্তাহের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য-বিবৃতি ছাড়াও বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একজন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তারের ঘটনার জের ধরে ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ হাই কমিশনে হামলার ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এ ঘটনায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত প্রণয় ভার্মাকে গত মঙ্গলবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। এরপর ভারতের কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রধানরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বৃহস্পতিবার ঢাকায় ফিরে এসেছেন।