টাকা ও রুপিতে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য লেনদেনের উদ্যোগ
2023.04.20
ঢাকা
বৈদেশিক লেনদেনের অতি পরিচিত মাধ্যম মার্কিন ডলার সংকটে বিকল্প হিসেবে ভারতীয় রুপি ও বাংলাদেশি টাকায় লেনদেনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এর অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ও বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংকে হিসাব খুলতে আগ্রহ দেখিয়েছে। অনুরূপভাবে ভারতের দুটি ব্যাংকও বাংলাদেশে দুটি ব্যাংকে হিসাব খুলবে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের দুটি ব্যাংক ভারতে হিসাব খোলার জন্য বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছে।
ইস্টার্ণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদনের বিষয়টি বেনারকে নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন পেলে ব্যাংক দুটি ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায় আবেদন করবে। সেখান থেকে অনুমোদন পেলে সেখানে অ্যাকাউন্ট খোলা হবে।
“এরপর লেনদেন শুরু হবে,” বলেন আলী রেজা ইফতেখার।
এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন হলে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা অর্থ পাবেন টাকায় এবং বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানিকারকরা অর্থ পাবেন রুপিতে।
দুটি ব্যাংকের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু হলেও ধীরে ধীরে অন্যান্য ব্যাংকও এতে যুক্ত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
টাকা ও রুপি লেনদেনের বিষয়টি বর্তমানে “প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে” জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বেনারকে বলেন, এ প্রসঙ্গে ব্যাংকগুলোকে “খোঁজখরব করতে” বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের বৈশ্বিক বাণিজ্য এখন ডলারনির্ভর। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে, যা এখনো অব্যাহত আছে।
আমদানিকারকরা সংকট শুরুর আগে প্রতি ডলারের জন্য ৮৪ টাকা ব্যয় করলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, তা ১০৬ টাকায় উঠেছে।
ডলারের ওপর এই চাপ কমাতে তৃতীয় দেশের মুদ্রায় লেনদেন বাড়াতে চাইছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে হিসাব খুলে লেনদেন করা যাবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রাশিয়ার সহায়তায় পাবনার রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের ৩১৮ মিলিয়ন ডলার চীনের মুদ্রা ইউয়ানের মাধ্যমে পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।
এদিকে কোন প্রক্রিয়ায় টাকা ও রুপিতে লেনদেন হতে পারে, সে বিষয়টি আলোচনা করতে প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ভারতের আলোচ্য দুই ব্যাংকের এক প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে ইস্টার্ন ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে বেনারকে জানান আলী রেজা ইফতেখার।
ভোক্তাদের জন্য ‘উপকার’ বয়ে আনতে পারে
টাকা ও রুপি দিয়ে লেনদেন সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে ডলারের ওপর চাপ কমবে এবং দীর্ঘমেয়াদে ভোক্তার জন্য উপকার বয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরাও।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের উপদেষ্টা ড. মোস্তফা আবিদ খান বেনারকে বলেন, “টাকা ও রুপিতে লেনদেন সফলভাবে করা গেলে ডলারের ওপর চাপ কমে আসবে। তখন টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য কমতে পারে। ফলে আমদানি পণ্যের দামও কমে আসার সুযোগ তৈরি হবে এবং তা ভোক্তার ব্যয়ের চাপ কমিয়ে আনতে সহায়ক হতে পারে।”
“তবে এসব নির্ভর করবে উভয় দেশ কীভাবে তা বাস্তবায়ন করে, তার ওপর,” যোগ করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ বেনারকে বলেন, “টাকা ও রুপিতে লেনদেন চালু হলে উভয় দেশের বাণিজ্য আরো সহজ হবে।”
আগামী জুন থেকে টাকা ও রুপির লেনদেন শুরু হতে পারে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ রপ্তানিকৃত পোশাকের জন্য ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় তুলা ও সুতা।
এমন একজন আমদানিকারক এবং পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বেনারকে বলেন, “এই উদ্যোগ ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। কেননা এতে ডলারের ওপর চাপ কিছুটা হলেও কমবে।”
প্রাথমিকভাবে লেনদেন হবে দুই বিলিয়ন ডলারের
বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো’র (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে উভয় দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৬ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এর মধ্যে বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি করেছে ১৩.৬৯ বিলিয়ন ডলারের আর ভারতে রপ্তানি করেছে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ যে পরিমাণ রপ্তানি করেছে, কেবল ওই পরিমাণ অর্থের লেনদেন টাকা ও রুপিতে করা যাবে। ভারত থেকে বাদবাকি আমদানি পণ্যের অর্থ ডলারে পরিশোধ করতে হবে।
“প্রাথমিকভাবে দুই বিলিয়ন ডলারের লেনদেন উভয় দেশের মুদ্রায় করা যাবে,” জানিয়ে আব্দুল মাতলুব আহমাদ বলেন, “যে পরিমাণ লেনদেন টাকা ও ভারতীয় রূপিতে হবে, ওই পরিমাণ ডলার সরকারের জন্য থাকবে, যা দিয়ে ডলারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারবে।”
তবে শুরুতেই দুই বিলিয়ন ডলারের লেনদেন হবে না, বরং এটি ধীরে ধীরে বাড়বে বলে মনে করেন আলী রেজা ইফতেখার।
‘চেষ্টা করতে সমস্যা নেই’
ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উভয় দেশের মুদ্রায় লেনদেন হলেও কোন ধরনের আমদানিকারক বা রপ্তানিকারক এ সুবিধার আওতায় আসবেন, বিনিময় হার কী হবে – এমন কিছু বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “দুই বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিনিময় ঠিক আছে। কিন্তু এর উপরে বিনিময় করতে গেলে বিনিময় মূল্য কী হবে। তা যদি বেশি হয়, তাহলে সুবিধাজনক হবে না।”
অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, “ডলার সব দেশে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু ইন্ডিয়ান রুপি পেলে ওই রুপি দিয়ে বাংলাদেশের আমদানিকারক যদি তৃতীয় কোনো দেশ থেকে পণ্য কিনতে চায়, তা সম্ভব হবে না, কারণ ভারতীয় রুপি সবাই ব্যবহার করে না।”
তখন আমদানিকারককে আবার রুপি দিয়ে ডলার কিনতে হবে, তাতে খরচ বাড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি।
“তবুও চেষ্টা করতে তো সমস্যা নেই,” বলেন আহসান এইচ মনসুর।