কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহারে বাংলাদেশ-ভারত সমঝোতা

আহম্মদ ফয়েজ ও পরিতোষ পাল
2022.09.06
ঢাকা ও কলকাতা
কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহারে বাংলাদেশ-ভারত সমঝোতা নয়াদিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে শীর্ষ বৈঠকের আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২।
[সৌজন্যে: ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তর]

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার দিনের ভারত সফরের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার ভারত থেকে বাংলাদেশের সিলেটে প্রবাহিত কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহারে একটি সমঝোতা স্মারক সাক্ষর হয়েছে।

কুশিয়ারা পানি প্রত্যাহারে সমঝোতা স্মারক সাক্ষরের ফলে যৌথ নদী কুশিয়ারা থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলন করতে পারবে বাংলাদেশ।

এই পানি প্রত্যাহারসহ নয়াদিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়। দুই দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে মোট সাতটি সমঝোতা স্মারক সাক্ষর হয়।

এই আনুষ্ঠানিকতার পর এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে প্রতিবেশী কূটনীতির রোল মডেল বলে অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করছেন, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে সমাধান করা অন্যান্য অনেক সমস্যার মতোই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিসহ সকল অমীমাংসিত সমস্যা শিগগিরই সমাধান হবে।

গত এক দশকে উভয় দেশই বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে উল্লেখ করে হাসিনা বলেন, “দুটি দেশ বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার চেতনায় অনেক অমীমাংসিত ইস্যু সমাধান করেছে। এবং আমরা অবিলম্বে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি দ্রুত সাক্ষর করাসহ সকল অমীমাংসিত ইস্যুর সমাধান আশা করছি।”

দুই দেশের মধ্যে কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহার বিষয়ক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিসহ ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর পানি বণ্টনের মতো সব সমস্যার সমাধান করা হবে।

সাত সমঝোতা স্মারক

শেখ হাসিনার ভারত সফরের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে— অভিন্ন সীমান্ত নদী কুশিয়ারা থেকে ভারত ও বাংলাদেশের পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে ভারত সরকারের জল শক্তি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সরকারের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক, ভারতে বাংলাদেশের রেলওয়ে কর্মীদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে ভারতের রেল মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশের রেলওয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য আইটি সিস্টেমে সহযোগিতার জন্য ভারতের রেল মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশের রেলওয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক।

অন্যান্য স্মারকগুলো হচ্ছে- ভারতে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল অফিসারদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি কর্মসূচির বিষয়ে ভারতের ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে সমঝোতা স্মারক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহযোগিতার বিষয়ে ভারতের কাউন্সিল ফর সাইন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ(সিএসআইআর) ও বাংলাদেশের কাউন্সিল অব সাইন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর) এর মধ্যে সমঝোতা স্মারক, মহাকাশ প্রযুক্তির ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক এবং প্রসার ভারতী ও বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)’র মধ্যে সম্প্রচার সহযোগিতা সংক্রান্ত স্মারক।

সেপা চুক্তির আলোচনা শিগগির: মোদী

মঙ্গলবার শেখ হাসিনার সাথে আলোচনার পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করতে দুদেশের মধ্যে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির (সেপা) জন্য শিগগির আলোচনা শুরু হবে।

উভয় দেশ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের ওপর একটি যৌথ গবেষণায় জড়িত, যা বহু বছর ধরে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে আলোচনায় রয়েছে জানিয়ে মোদী বলেন, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো বাজার ভারতের। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আমরা বাণিজ্য বাড়াতে আগ্রহী। সে জন্য দুই দেশের মধ্যে কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট- সেপা সই করার লক্ষ্যে আমরা কার্যক্রম শুরু করব।

বাংলাদেশকে ভারতের অত্যন্ত বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করে সফর সম্পর্কে মোদী বলেন, “আমার পূর্ণ বিশ্বাস, আগামী ২৫ বছরে ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যাবে।”

এদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি টুইটারে লিখেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত বাংলাদেশকে প্রায় ৯.৫ বিলিয়ন ডলার অগ্রাধিকারমূলক ঋণ দিয়েছে এবং বেশ কিছু সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

উল্লেখ্য, সেপা চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা পাবে। ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যে আরও গতি আসবে বলেন মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

এই সফর গুরুত্বপূর্ণ

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে দুই দেশের কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। তিন বছরের ব্যবধানে শেখ হাসিনার এই ভারত সফরকে প্রত্যাশার সফর বলে আখ্যায়িত করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, “কানেকটিভিটিসহ অনেক বিষয়ই অগ্রগতি হলেও বাংলাদেশের পানির চাহিদা ভারত এখনো পূরণ করতে পারেনি। তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জন্য আটকে রয়েছে। তবে কুশিয়ারা নিয়ে এই সফরে চুক্তি হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “চীনের সাথে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের নিরিখে শেখ হাসিনার এই ভারত সফর অন্য মাত্রা নিয়েছে।”

বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব আনাম খান বলেন, “করোনা মহামারির পর প্রধানমন্ত্রীর এই ভারত সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে অর্থনৈতিক দিক থেকে এই সফরটি খুবই গুরুত্ব বহন করছে।”

“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেছেন যে তিস্তা চুক্তি অচিরেই হবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ভারতের দিক থেকে আমাদের যে বিষয়গুলো এখনো অমীমাংসিত আছে তার অধিকাংশ বিষয়েই এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি,” যোগ করেন তিনি।

“তবে খুব ভালো দিক হচ্ছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী পানির বিষয়টি খুবই ভালোভাবে তুলে ধরেছেন,” বলেন শাহাব।

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের প্রথম দুই দিনের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এই সফরে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক বিষয়গুলোই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।

মৈত্রী পাওয়ার প্ল্যান্টের উদ্বোধন

হাসিনা এবং মোদী খুলনার রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা চালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মৈত্রী পাওয়ার প্ল্যান্টের ইউনিট-১ যৌথভাবে ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেছেন।

কনসেশনাল ফাইন্যান্সিং স্কিমের অধীনে ভারতীয় উন্নয়ন সহায়তা হিসাবে ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ প্রায় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সুন্দরবনের পাশে রামপালে স্থাপন করা হচ্ছে।

সুন্দরবনের কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে দুই দেশসহ বহু আন্তর্জাতিক সংগঠন বিরোধিতা করে আসছিল।

গত বছর বাংলাদেশ সফরে এসে এই প্রকল্পটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরিও।

একই বছর এই প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোও।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।