রামগড় স্থলবন্দর উদ্বোধন: ত্রিপুরা থেকে সড়কপথে ৩ ঘণ্টায় আসা যাবে চট্টগ্রাম বন্দর
2023.11.14
ঢাকা
দেশের তিন পার্বত্য জেলার সঙ্গে সড়কপথে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সরাসরি সংযোগের জন্য নির্মিত রামগড় সেতু ও রামগড় স্থলবন্দর মঙ্গলবার উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি খাগড়াছড়ির রামগড় সেতু ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট উদ্বোধনের বিষয়টি বেনারের কাছে নিশ্চিত করেন রামগড় উপজেলা চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কুমার কারবারী।
গত ১ নভেম্বর আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ উদ্বোধনের পর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আট রাজ্যের সাথে সড়ক পথে সরাসরি স্বল্প দূরত্বের এই পথ উদ্বোধন করা হলো।
উদ্বোধনের পর ভারত থেকে দুটি গাড়ি বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বাংলাদেশ থেকে দুটি ট্রাক ভারতে যায় বলে বেনারকে জানান রামগড় পৌরসভার কাউন্সিলর আবুল কাশেম।
তিনি বলেন, রামগড় ব্রিজ এবং স্থলবন্দর পুরোদমে চালু হলে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বনিম্ন দূরত্বের সড়কপথ খুলে যাবে। ত্রিপুরা থেকে সড়কপথে রামগড় সেতু হয়ে একশ’ কিলোমিটারের কম দূরত্ব পাড়ি দিতে সময় লাগবে তিন ঘণ্টা।
“এর ফলে দুই দেশের সীমান্ত বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ, মানুষের যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে, বিকশিত হবে পর্যটন শিল্প, এমনটাই আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা,” বলেন আবুল কাশেম।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন তাঁর কূটনৈতিক জীবনের অধিকাংশ সময় কলকাতা ও দিল্লীতে বাংলাদেশি কূটনীতিক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, রামগড় সেতু ও স্থলবন্দর বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের জন্যই সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারে।
মঙ্গলবার তিনি বেনারকে বলেন, “রামগড় সেতু ভারতের ভূমি বেষ্টিত ত্রিপুরা এবং আসামকে সবচেয়ে কম দূরত্বে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে যুক্ত করবে। সেখান থেকে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি হয়ে রামগড় সেতু পার হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর এবং কক্সবাজার আসা যাবে।”
তৌহিদ হোসেন জানান, ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির থেগামুখ দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সাথে যোগাযোগ ছিল। কিন্তু থেগামুখে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া খুব কঠিন ছিল।
“১৯৬৫ সালের পর এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে আট উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সরাসরি সড়কপথে যোগাযোগ স্থাপিত হলো,” বলেন তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, “এই রামগড় সেতুর আরেকটি বিশেষত্ব হলো, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের যে অঞ্চলে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী বসবাস করে সেই অঞ্চলের সাথে সবচেয়ে সুবিধাজনক যোগাযোগ স্থাপিত হলো।”
এর ফলে ভারত থেকে বাংলাদেশে পর্যটকের সংখ্যা বাড়া ও দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য থেকে সহজেই মালামাল চট্টগ্রাম বন্দরে নেয়া যাবে এবং ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন তিনি।
তবে তৌহিদ হোসেনের মতে, রামগড় সেতু হয়ে ভারতের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে “একটি সমস্যা রয়েছে। সেটি হলো, বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভালো নয়।”
তিনি বলেন, “রামগড় সেতু হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সাথে স্থাপিত যোগাযোগ কাজে লাগাতে হলে নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে।”
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানান, মঙ্গলবার উদ্বোধন করা হলেও রামগড় স্থলবন্দরটির কার্যক্রম শুরু হতে পারে আগামী বছর জুনে।
রামগড় স্থলবন্দরের কাজ এখনো “পুরোপুরি শেষ হয়নি” জানিয়ে রামগড় পৌরসভার কাউন্সিলর মোঃ আবুল কাশেম বেনারকে বলেন, বর্তমানে এই সীমান্ত দিয়ে কেউ চলাচল করে না এবং সেখানে সীমান্ত বাণিজ্যও নেই।
এই সীমান্ত দিয়ে বর্তমানে “কেবলমাত্র চোরাকারবারিরা বিভিন্ন পণ্য নিয়ে আসে,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “স্থলবন্দর চালু হলে অনেকেই সেটি ব্যবহার করে সহজে চলাচল করতে পারবে।”
“আমাদের যা জানানে হয়েছে সেটি হলো, ভারত থেকে ট্রাকে করে মালামাল এনে রামগড়ে লোড-আনলোড করা হবে। যদি সেটা করা হয় তাহলে এখানকার মানুষ কিছু কাজ পাবে। কিছু স্থানীয় ব্যবসা গড়ে উঠবে। অন্যথায় ভারতীয় অথবা বাংলাদেশি ট্রাক সরাসরি চলে গেলে এখানে স্থানীয় মানুষের কোনো লাভ হবে না,” যোগ করেন আবুল কাশেম।
“সেভেন সিস্টার” নামে খ্যাত ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় বিশাল ভূখণ্ড বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মাধ্যমে মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা। এই অঞ্চলের একমাত্র সুবিধাজনক বন্দর হলো চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে সহজে ত্রিপুরা যাওয়া গেলেও ফেনী নদীর ওপর সেতু না থাকায় সেটি সম্ভব ছিল না।
সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ভারত সরকারের অর্থায়নে ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ফেনী নদীর ওপর নির্মাণ করা হয় বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু।
২০২১ সালের মার্চে এই সেতু উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তবে উদ্বোধন হলেও স্থলবন্দর এবং কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন সুবিধা না থাকায় তা কার্যকর করা যায়নি।
রামগড় হয়ে ভারতে যাওয়ার রাস্তা প্রশস্ত করতে প্রকল্প গ্রহণ করে বাংলাদেশের সড়ক ও জনপথ বিভাগ। মোট ৩৮ কিলোমিটার বারিয়ারহাট-হেয়াকো-রামগড় রাস্তাটি প্রশস্ত করতে ১১শ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করছে সরকার। এর মধ্যে প্রায় ৫৮২ কোটি টাকা ঋণ হিসাবে দিচ্ছে ভারত সরকার। বাকি অর্থ খরচ করছে বাংলাদেশ।
‘ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ পাননি’
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির প্রধান গৌতম দেওয়ান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “রামগড় সড়ক, সেতু ও স্থলবন্দর নির্মাণ দেশের জন্য ভালো হয়েছে। ভারতের সাথে আমাদের যোগাযোগ সহজ হবে। সার্বিকভাবে দেশ লাভবান হবে। তবে স্থানীয় অনেকে ব্যক্তিগতভাবে ও সমষ্টিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেকের জমির মধ্যে দিয়ে এমনকি ধানখেতের মধ্যে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের সাথে কোনো প্রকার পরামর্শ করা হয়নি।”
গৌতম দেওয়ান বলেন, “ক্ষতিগ্রস্তদের আগে থেকে জানানো হয়নি যে তাদের জমির ওপর দিয়ে এই রাস্তা নির্মাণ করা হবে। তাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁরা ক্ষতিপূরণ পাননি।”
তিনি বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এগুলো খাস জমি। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে জমির মালিকানা মূলত সম্মিলিত মালিকানায় থাকে। বাস্তবায়নকারীরা সমতলের আইন পার্বত্য জেলায় প্রয়োগ করছেন যা আইনগত দিক থেকে ঠিক নয়।”
গৌতম দেওয়ান বলেন, “সরকারের উচিত বিষয়টি বিবেচনা করে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা।”
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী তাঁর নামে নামকরণ করা শেখ হাসিনা সরণি (পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে) এবং চট্টগ্রামের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ ১৫৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১০ হাজার ৪১টি স্থাপনা উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে মঙ্গলবার বক্তব্য রাখেন।
বাসস জানায়, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি মোট ৯ হাজার ৯৯৫টি অবকাঠামো নির্মাণ সমাপ্ত কাজের উদ্বোধন এবং ৪৬টি অবকাঠামোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।