টাঙ্গাইল শাড়ির ভৌগোলিক নির্দেশক পেতে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা লাগতে পারে বাংলাদেশের

অয়ন আমান
2024.02.08
ঢাকা
টাঙ্গাইল শাড়ির ভৌগোলিক নির্দেশক পেতে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা লাগতে পারে বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে তাঁতে ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি বুনছেন একজন কর্মী। ১৮ নভেম্বর, ২০২২।
[সুদীপ্ত সালাম/বেনার নিউজ]

টাঙ্গাইল শাড়িকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ঐতিহ্য দাবি করার এক সপ্তাহ পর এটিকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে নিবন্ধন করে বৃহস্পতিবার গেজেট প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ।

এটির জিআই পেতে বিরোধ নিষ্পত্তিতে প্রয়োজনে ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশনে যাওয়ার কথা বলছে বাংলাদেশ শিল্প মন্ত্রণালয়।

বিশ্লেষকদের মতে, টাঙ্গাইল এলাকাটি বাংলাদেশের অংশ, তাই এই এলাকায় উৎপাদিত শাড়ির ওপর বাংলাদেশের একচেটিয়া অধিকার রয়েছে। টাঙ্গাইল শাড়ির জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) না পেলে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর বৃহস্পতিবার টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই নিবন্ধন গেজেট প্রকাশ করে।

এ প্রসঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা বেনারকে বলেন, “যার যার নিজস্ব এলাকার পণ্য সে স্বীকৃতি দিতে পারে। ভারত তাদেরটা দিয়েছে, আমরা আমাদেরটা দিয়েছি।”

তিনি আরও বলেন, “যদি বিরোধ বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তখন ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে সমাধান (সেটেলমেন্ট) করা হবে।”

চলতি বছরের জানুয়ারির শুরুতে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেড মার্কস বিভাগ স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক সমালোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়।

মূল ধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের এই উদ্যোগের সমালোচনার পাশাপাশি এত দিনেও বাংলাদেশ স্বীকৃতি না নেওয়ার প্রসঙ্গ সামনে আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সীমা জামান বেনারকে বলেন, “ভারত টাঙ্গাইলের শাড়ির গেজেট করেছে এবং আমরাও করেছি। আমাদের অধিকার স্বীকৃত। তাই দুই দেশের সরকার পর্যায়ে দর কষাকষির মাধ্যমে সমঝোতায় যেতে হবে।”

তিনি বলেন, “দর কষাকষির মাধ্যমে সমঝোতা না হলে আমাদের আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যস্থতা ছাড়া এ ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তি হয় না।”

বাংলাদেশের নিবন্ধন বিলম্বিত

২০১৩ সালে বাংলাদেশে পেটেন্ট আইন পাস হওয়ার পরে ২১টি পণ্য জি আই হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে। এখন আরও ১৪টি পণ্য নিবন্ধনের অপেক্ষায় রয়েছে।

যার মধ্যে রয়েছে, যশোরের খেজুর গুড়, নরসিংদীর লটকন ও অমৃতসাগর কলা, জামালপুরের নকশী কাঁথা, মধুপুরের আনারস, সুন্দরবনের মধু, মৌলভীবাজারের আগর-আতর, রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম, মুক্তাগাছার মণ্ডা, রাজশাহীর মিষ্টিপান, শেরপুরের ছানার পায়েস, ভোলার মহিষের কাঁচা দুধ, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা, নওগাঁর নাগ ফজলি আম।

টাঙ্গাইল শাড়ি জিআই নিবন্ধনে বিলম্ব হয়েছে বলে মনে করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. মাসুম বিল্লাহ।

তিনি বেনারকে বলেন, “ভারতের নিজস্ব জিআই আইন আছে, আমাদেরও নিজস্ব জিআই আইন হয়েছে। তাদের জিআই ওখানে বলবৎ থাকতে পারে। আমাদের জিআই এখানে বলবৎ থাকতে কোনো বাধা নেই।”

তিনি বলেন, “ভারত যখন টাঙ্গাইল শাড়ি জিআই হিসেবে নিবন্ধন করে, তখন ওই নোটিশটি হয়তো আমাদের কাছে আসেনি। আমরা ভারত সরকারকে আপত্তি জানাতে পারিনি। বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ি নিবন্ধনের পর ভারত সরকারও জানবে যে, প্রকৃত জিআই আমাদের প্রাপ্য।”

Tangail-04.jpg
টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে তাঁতে ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি বুনছেন একজন কর্মী। ১৮ নভেম্বর, ২০২২। [সুদীপ্ত সালাম/বেনার নিউজ]

টাঙ্গাইলের ওপর বাংলাদেশের দাবি বেশি

ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষক আসাদুল্লাহ গালিব বেনারকে বলেন, “ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য প্রথমে নিজ দেশে, আঞ্চলিকভাবে ও আন্তর্জাতিকভাবে নিবন্ধন করতে হয়। ভারত যখন নিবন্ধন করে ফেলেছে, তখন বাংলাদেশের পদক্ষেপ এটিই ছিল।

“এখন একটা বিরোধ সামনে আসে যে, টাঙ্গাইলের শাড়ির জিআই কার? টাঙ্গাইল অবিভক্ত ভারতের অংশ ছিল, এটা সত্য। কিন্তু গত ৭৬ বছর টাঙ্গাইল ভারতের অংশ নয়। ২৩ বছর পাকিস্তানের ও ৫৩ বছর বাংলাদেশের অংশ টাঙ্গাইল। তাই ভারত টাঙ্গাইলে উৎপাদিত শাড়ির জিআই দাবি করতে পারে না,” বলেন তিনি।

গালিব বলেন, “বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে এই বিরোধ নিষ্পত্তিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে যাওয়া। আমাদের এখানে অধিকারের পাল্লা ভারী। বাংলাদেশের পক্ষেই রায় আসা উচিত। যদি কোনো কারণে না হয় তাও অন্তত দুপক্ষই পেতে পারে।”

পণ্যের জিআই নিবন্ধনের সুবিধা-অসুবিধা

গালিব আরও বলেন, “ভৌগোলিক পণ্য একই ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্য ভূ-খণ্ডে উৎপাদন করলেও সে রকম পণ্য হবে না। এটা ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদি সেটা না হয় তার অর্থ হলো, একটা নিবন্ধনের বলে সেটা নস্যাৎ করে দেওয়া।”

তিনি বলেন, “এক দেশে উৎপাদিত পণ্য; যে পণ্যের সঙ্গে সে দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি জড়িত, সেই পণ্য যদি অন্য কোনো দেশ নিবন্ধন পায় তাহলে সেটা এক ধরনের প্রতারণা। বাংলাদেশের তুলনায় ভারত একটু উন্নত দেশ হওয়ায় তারা টাঙ্গাইলের শাড়ি যত বেশি বাণিজ্যিকিকরণ করতে পারবে, আমরা হয়তো ততটা পারবো না।”

“জিআই না পেলে আমাদের সম্ভাবনাময় একটা খাত হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং আর্থিকভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। সাংস্কৃতিকভাবেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, এর সঙ্গে মর্যাদা ও ঐতিহ্যের বিষয় যুক্ত,” যোগ করেন তিনি।

মাসুম বিল্লাহ বলেন, “বিশ্ব বাজারে যখন এই পণ্য যাবে তখন প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। যেহেতু প্রতিযোগী তৈরি হয়ে গেছে, আমরা বাজার হারাব।”

তিনি বলেন, “জিআই মূলত কোনো পণ্যের প্রকৃত গুণ ও বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে। এটা বাজার সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখে। প্রকৃতপক্ষে যারা এই পণ্য উৎপাদন করেন, তারা লাভবান হন ও উৎসাহ বোধ করেন।”

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন রিয়াদ হোসেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।