ভারতের ৮ রাজ্যের সাথে যুক্ত বাংলাদেশ, বাড়বে বাণিজ্য সম্ভাবনা

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.11.01
ঢাকা
ভারতের ৮ রাজ্যের সাথে যুক্ত বাংলাদেশ, বাড়বে বাণিজ্য সম্ভাবনা ট্রায়াল রানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের আখাউড়ার গঙ্গাসাগর রেলস্টেশন থেকে ভারতের আগরতলার নিশ্চিন্তপুর রেলস্টেশন যাওয়ার পথে প্রথম ট্রেনটি দুই দেশের সীমান্ত অতিক্রম করছে। সীমান্তে ভারত (ডানে) ও বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের দেখা যাচ্ছে। ৩০ অক্টোবর ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

বহুল আলোচিত আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ চালু হওয়ায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আট রাজ্যের সাথে সরাসরি যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ।

এর ফলে কলকাতা থেকে আগরতলায় রেল সড়কের বর্তমান দূরত্ব এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার থেকে নেমে আসবে সাড়ে পাঁচশ কিলোমিটারে। যাতায়াতে লাগবে ১৪ ঘণ্টার পরিবর্তে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা।

বুধবার ভার্চুয়ালি যৌথভাবে আখাউড়া-আগরতলা এবং খুলনা-মংলা রেল সংযোগ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁরা মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের দ্বিতীয় ইউনিটও উদ্বোধন করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দুটি রেল সংযোগ পুরো দক্ষিণ এশিয়া ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি ভারতের আঞ্চলিক অখণ্ডতার হুমকি দূর করতে সহায়তা করবে। এছাড়া বৃদ্ধি পাবে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ভবিষ্যতে ভারতের সাথে বিদ্যমান সম্পর্ক আরও জোরদার হবে।

বুধবার যৌথভাবে উদ্বোধন হওয়া তিনটি প্রকল্প “দুই বন্ধুপ্রতীম দেশের মধ্যকার অনন্য সাধারণ বন্ধুত্ব ও পারষ্পরিক সহযোগিতারই বহিঃপ্রকাশ,” বলেন শেখ হাসিনা।

বাণিজ্যে সুযোগ বাড়বে

বর্তমানে কলকাতা থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে রেলওয়ের মাধ্যমে মালামাল বহন করতে ১৪ ঘণ্টা সময় লাগে বলে বুধবার বেনারকে জানান বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ-ভারত ইন্টারচেঞ্জ শাখার উপপরিচালক কালিকান্ত ঘোষ।

তিনি বলেন, “আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগের মাধ্যমে কলকাতা থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পৌঁছানো যাবে, যা দুই দেশের মধ্যে দ্রুত ও সহজে পণ্য পরিবহন নিশ্চিত করবে।”

এই রেলপথ চালুর মাধ্যমে ভারতের বিশাল উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভূখণ্ডের সাথে বাংলাদেশ সরাসরি যুক্ত হয়ে গেলো বলে বুধবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে “কাঁচামালের দাম অনেক কম,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, রেল লাইন চালু হবার ফলে সেখান থেকে বাংলাদেশের শিল্পের জন্য সহজে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাঁচামাল আনার সুযোগ তৈরি হবে।

“ট্রাকের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনে যে ঝামেলা আমাদের পোহাতে হয় সেটিও আর থাকবে না। রেলগাড়ির মাধ্যমে পণ্য আনা সম্ভব হবে,” বলেন মাতলুব আহমাদ।

রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হলো মংলা বন্দর

আগে মংলা বন্দর সারাদেশের রেল সংযোগের সাথে সংযুক্ত ছিল না। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের রেল নেটওয়ার্কের সাথে মংলা বন্দর যুক্ত হলো।

বাংলাদেশের নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কমোডর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বুধবার বেনারকে বলেন, “এই সংযোগের ফলে দেশের উত্তরাঞ্চল সরাসরি মংলা বন্দরের সাথে যুক্ত হলো। সেখানে কোনো শিল্প-কারখানা স্থাপিত হলে পণ্য মংলা বন্দর দিয়ে স্বল্প খরচে বিদেশে রপ্তানি করা যাবে।”

“আবার ভারত চাইলে মংলা বন্দর থেকে মালামাল রেলের মাধ্যমে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পৌঁছাতে পারবে,” যোগ করেন তিনি।

এছাড়া এই রেল সংযোগের মাধ্যমে নেপাল-ভুটানও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারবে জানিয়ে তিনি বলেন, “এটি আমাদের জন্য একটি সুযোগ হতে পারে।”

তিনি বলেন, “সার্বিকভাবে এই দুই রেল সংযোগ প্রকল্প দক্ষিণ এশিয়া যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করবে। তবে, বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হবে, সেই পথ বাংলাদেশকেই বের করতে হবে।”

রেল সংযোগের রাজনৈতিক গুরুত্ব

আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগের রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের সাথে ভূমিবেষ্টিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সরাসরি যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ এবং উন্নয়নের এক নতুন যুগের সূচনা হবে। সেখান থেকে বাংলাদেশও লাভবান হবে। তারা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করবে।”

বাংলাদেশ ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আট রাজ্যকে আলাদা করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই আট রাজ্যের সাথে সরাসরি সংযোগের প্রভাব পড়বে “পুরো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সব ক্ষেত্রে।”

১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় আট রাজ্যে প্রবেশের দাবি ছিল। কিন্তু পাকিস্তান আমলে সেই অনুমতি দেয়া হয়নি।

ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা) গেরিলা গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চল থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যায়।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশে আটক হন উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের চরম অবনতি হয়।

২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের জেটিতে ১০ ট্রাক বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ আটক করে পুলিশ। এই ঘটনার সঙ্গে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সম্পৃক্ততা পরিষ্কার হয়ে যায়।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনে রাজি হয় বাংলাদেশ। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে আটক বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করে সরকার।

পর্যটনে গুরুত্ব বাড়বে ত্রিপুরার

গত সোমবার আখাউড়া-আগরতলা ট্রায়াল রানের সময় হাজির ছিলেন এই প্রকল্পে জমি দান করা ত্রিপুরার নিশ্চিন্তপুরের বাসিন্দা আন্নান মিঞা। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় ট্রেন আসবে।

বুধবারের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা বলেন, আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ চালু হওয়ার ফলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। তার মতে, এই প্রকল্পের ফলে আগামী দিনে ত্রিপুরা পরিবহন ও পর্যটনের গুরুত্বপূর্ণ হাব হয়ে উঠবে।

এ আন্তসীমান্ত রেল যোগাযোগ দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিপুল অগ্রগতির সম্ভাবনা তৈরি করবে বলে বেনারকে জানান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী।

তিনি বলেন, এর ফলে বাংলাদেশের বাণিজ্য যেমন বাড়বে, তেমনি ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনে যুগান্তকারী প্রভাব ফেলবে।

উল্লেখ্য, ১২.২৪ কিলোমিটার আখাউড়া-আগরতলা ক্রস-বর্ডার রেল সংযোগ প্রকল্পটি বাংলাদেশে ৬.৭৮ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ রেললাইন এবং ৫.৪৬ কিলোমিটার ত্রিপুরায়। মোট ৩৯২ কোটি টাকা ভারতের অনুদান সহায়তায় এটি বাস্তবায়িত হয়েছে।

খুলনা-মংলা বন্দর রেললাইন প্রকল্পটি ভারতের রেয়াতি লাইন অফ ক্রেডিট দিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে, যার মোট প্রকল্প ব্যয় ৩৮৯ মিলিয়ন ডলার (ভারতীয় এলওসি থেকে ৬৯ শতাংশ অর্থায়ন)।

প্রায় ৬৪ কিলোমিটার রেললাইনের নির্মাণ কাজ ৪ হাজার ২৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন হয়েছে।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।