যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদবিরোধী পুরস্কারে ভূষিত বাংলাদেশের চাকমা রানী ইয়েন ইয়েন

বেনারনিউজ স্টাফ
2023.08.09
ওয়াশিংটন ডিসি
যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদবিরোধী পুরস্কারে ভূষিত বাংলাদেশের চাকমা রানী ইয়েন ইয়েন ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের কাছ থেকে ‘গ্লোবাল এন্টি-রেসিজম চ্যাম্পিয়নস’ পুরস্কার গ্রহণ করছেন রানী ইয়েন ইয়েন। ৯ আগস্ট ২০২৩।
[এএফপি]

যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন কর্মীদের জন্য প্রথমবারের মতো চালু হওয়া পুরস্কার নিতে গিয়ে ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে পড়া বিশ্বের সকল সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষদের পক্ষে কথা বললেন বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা রানী ইয়েন ইয়েন।

বুধবার আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে আয়োজিত ‘গ্লোবাল এন্টি-রেসিজম চ্যাম্পিয়নস’ পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে পুরস্কারপ্রাপ্ত ছয় জনের পক্ষে বক্তব্য রাখেন ইয়েন ইয়েন (৩৯)। পুরস্কারপ্রাপ্ত অন্য পাঁচজন হলেন নেপাল, তিউনিসিয়া, মলডোভা, ব্রাজিল ও পেরুর নাগরিক।

“আমাদের অঞ্চল সংকুচিত করা, রাষ্ট্রীয় মদদে হাজারো অনাদিবাসী মানুষের আমাদের ভূমিতে বসতি স্থাপন, রাজনৈতিক মদদপুষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা আমাদের ভূমি দখল… এসব আমাদের পরিস্থিতির মাত্র কয়েকটি উদাহরণ, যা বিশ্বের অন্য যে কোনো অঞ্চলের সংখ্যালঘু ও আদিবাসীরাও মোকাবেলা করছেন,” বলেন চাকমা রানী ইয়েন ইয়েন যিনি নিজে মারমা জাতিগোষ্ঠীর একজন মানুষ।

“আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে পদ্ধতিগতভাবে কোণঠাসা” করার বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি, “নিজেদের ভূমি রক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য” আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত হতে সহায়তা করা এবং বর্ণবাদবিরোধী অ্যাডভোকেসি তাঁর কাজের মূল ক্ষেত্র বলে জানান ইয়েন ইয়েন।

তিনি বলেন, “সামনে এগোতে হলে… ক্রমাগত সংকুচিত হতে থাকা নাগরিক পরিধির মধ্যে আমাদের দেশগুলোতে আইনের শাসন ও নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধ উদার গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে আমাদের।”

“ন্যায়বিচারের পথ কখনো সুগম হয় না,” অধিকার আদায়ের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমাও বেঁধে দেয়া যায় না মন্তব্য করে তিনি বলেন “এই সংগ্রাম এক অব্যাহত কর্মসূচি।”

‘ন্যায়বিচার আদায়ে নির্ভীক ও উচ্চকণ্ঠ’

অনুষ্ঠানে পুরস্কার বিজয়ীদের কার্যক্রম পরিচয় করিয়ে দেবার সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেন, “আমরা সকলেই জানি, জাতিগত ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের জন্য প্রতিনিয়তই অসংখ্য মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বা তাঁদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে।”

ইয়েন ইয়েনকে “বৈষম্য, এমনকি সহিংস পরিস্থিতির মধ্যেও সমান অধিকার ও ন্যায়বিচার আদায়ে নির্ভীক ও উচ্চকণ্ঠ” হিসেবে উল্লেখ করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবরণীতে বলা হয়, তিনি তাঁর অঞ্চলে সরকারি মদদপুষ্ট বৈষম্য, ভূমিদখল, সহিংসতা ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ এক অধিকারকর্মী।

ইয়েন ইয়েন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, লিঙ্গসমতা কর্মসূচি বিষয়ে অবদান রাখা ছাড়াও আদিবাসী নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও তরুণদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে গবেষণা করেছন বলে পরিচিতিপত্রে উল্লেখ করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।

ব্লিনকেন ইয়েন ইয়েনের ওপর ২০১৮ সালে হামলার ঘটনা স্মরণ করে বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার দুই আদিবাসী কিশোরীর দোভাষীর কাজ করার সময় “পুলিশ সহিংসভাবে তাঁকে আক্রমণ করে।”

“তারা যদি তাঁকে চুপ করিয়ে দেবার আশা করে থাকে, তবে তা ব্যর্থ,” বলেন ব্লিনকেন। এর দু মাস পর ইয়েন ইয়েন জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামে যোগ দেন বলেও জানান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

“যাদের কণ্ঠ কেউ শোনে না, তাঁদের কথা প্রকাশের সুযোগ ও সক্ষমতা যখন আমার আছে, তখন আমার তা করা উচিত। আমি একজন নাগরিক হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন করছি,” ইয়েন ইয়েনের এই বিবৃতি উদ্ধৃত করে ব্লিনকেন বলেন “এটি আমাদের সবার জন্যই খুবই শক্তিশালী এক বার্তা।”

09 BD-US-award-2.jpg
‘গ্লোবাল এন্টি-রেসিজম চ্যাম্পিয়নস’ পুরস্কার গ্রহণের পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে বক্তব্য রাখছেন রানী ইয়েন ইয়েন। ৯ আগস্ট ২০২৩। [মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ভিডিও থেকে নেয়া স্ক্রিনশট]

‘মানুষই প্রেরণা’

পুরষ্কার গ্রহণের আগের দিন ইয়েন ইয়েন বেনারকে জানান, তাঁর কাজের মূল ক্ষেত্র তরুণ ও নারী।

“কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা দিয়ে অধিকার আদায় সম্ভব নয়, অব্যাহত এই কার্যক্রম তরুণদেরকেই ভবিষ্যতে এগিয়ে নিতে হবে,” বেনারকে বলেন ইয়েন।

“নারীদের চ্যালেঞ্জ শুধু আদিবাসী হিসেবে নয়, নারী হিসেবে সমাজের অন্যদের থেকে অনেক বেশি,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “নারীদেরকে নিজেদের প্রথাগত সমাজের ভেতরেও অধিকার নিশ্চিত করতে লড়তে হয়, ফলে নারীদেরকে শুধু আদিবাসী হিসেবে নয় বরং নারী হিসেবেও এগিয়ে আসতে হবে।”

ইয়েন ইয়েন ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ পড়তে যান, কোর্স শেষে ২০১৪ সালে ফিরে এসে মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম শুরু করেন।

“অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে গিয়ে আমার মনে হলো, শুধু গবেষণার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে অধিকার অর্জন সম্ভব নয়। এর সাথে সমন্বিত মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম প্রয়োজন,” বলেন ইয়েন ইয়েন।

তিনি বলেন, নিজের অনুপ্রেরণাতেই মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করার পর “যখন আমি মানুষের সাথে মিশলাম, তখন তারাই হয়ে উঠল আমার কাজের অনুপ্রেরণা।”

“এই পুরষ্কার এবং স্বীকৃতি আমাদেরকে এবং আমাদের ইস্যুগুলোকে অন্যদের চোখের সামনে তুলে ধরবে। আমাদের বিষয়গুলো অন্যদেরকে জানানো প্রয়োজন, এই স্বীকৃতি সেক্ষেত্রে আমাদের সহায়ক হবে,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরাও ইয়েন ইয়েনের সাহসিকতার প্রশংসা করেন। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রাঙ্গামাটিতে দুই মারমা বোনকে ধর্ষণ ও হয়রানির ঘটনা কেন্দ্র করে ফেব্রুয়ারিতে স্থানীয় সদর হাসপাতালে ইয়েন ইয়েনের ওপর হামলা চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

“সেই ঘটনায় তিনি শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তবুও কোনো ধমক বা হুমকি তাঁকে দমাতে পারেনি,” উল্লেখ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান বেনারকে বলেন, “ঘটনাটি নিশ্চয়ই সবার মনে থাকবে।”

“তাঁর যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদবিরোধী পুরস্কার অর্জনে আমরা গর্বিত। তিনি পাহাড়ের মানুষের অধিকার আদায়ে একজন সাহসী ব্যক্তিত্ব,” যোগ করেন তিনি।

“আদিবাসী জনগোষ্ঠীর, বিশেষত নারীদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়ায় তিনি অনেক বাঁধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন। তবুও কোনোদিন পিছপা হননি,” বলেন নিরুপা দেওয়ান।

২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার ভেতর ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ লাখের কিছু বেশি। এর মধ্যে বৃহত্তর দুটি আদিবাসী, চাকমাদের জনসংখ্যা চার লাখ ৮৩ হাজার ও মারমাদের জনসংখ্যা প্রায় সোয়া দুই লাখের মতো।

ব্যক্তিগতভাবে ইয়েন ইয়েন মারমা জনগোষ্ঠীর মানুষ, ২০১৪ সালে চাকমা রাজাকে বিয়ে করার ফলে এখন তিনি একই সাথে চাকমা রানী।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আনুমানিক ৯০ হাজার আদিবাসী মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত বলে জানায় ২০২২ সালের যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন।

১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ার পাশাপাশি “সরকারি চাকরি ও শিক্ষাব্যবস্থায় সংরক্ষিত কোটা থাকার পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠী ব্যাপক মাত্রায় বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার,” বলা হয় ওই প্রতিবেদনে।

এতে বলা হয়, স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের দাবি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে, “সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন, হুমকি ও আদিবাসীদের মিথ্যা অভিযোগে আটকের পাশাপাশি মানবাধিকার কর্মীদের সন্ত্রাসী ও অপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে।”

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে সুনীল বড়ুয়া।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।