বিএনপির করা দ্রুত বিচার আইন স্থায়ী করল আওয়ামী লীগ
2024.03.05
ঢাকা
বিএনপির আমলে ২০০২ সালে আওয়ামী লীগের বিরোধিতার মুখে পাশ হওয়া দ্রুত বিচার আইনকে স্থায়ী রূপ দিলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) সংশোধন বিল-২০২৪ পাশের প্রস্তাব করলে সেটি কণ্ঠভোটে পাশ হয়।
তবে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বিলটির বিরোধিতা করে।
বিরোধী দল ও মানবাধিকারকর্মীদের আশঙ্কা, বিতর্কিত এই আইনে বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষের হয়রানি বাড়বে। তবে সরকারের ভাষ্য, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় আইনটির প্রয়োজন রয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “এই আইনের মাধ্যমে বিরোধী দলকে দমনের যে অভিযোগ করা হচ্ছে, সেটির কোনো ভিত্তি নেই।”
তিনি বলেন, “আমাকে দেখান, এই আইনটি বিরোধী দলের কয়জন সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। কয়জন নেতা সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন?”
“আইনটির প্রয়োজন আছে,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই আইনের আওতায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করা হয়, ফলে অপরাধীরা ভয়ে থাকে।”
এই আইনের কারণে দেশে অপরাধ সংঘটনের হার কম আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে বছরের পর বছর মামলা চলে এবং অপরাধীরা জামিনে বের হয়ে অপরাধ করতেই থাকে। দ্রুত বিচার আইনে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার বিধান আছে। যে কারণে সাক্ষী পাওয়া যায়, মামলার তদন্ত প্রতিবেদন তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়।”
বিএনপি আমলে ২০০২ সালে আওয়ামী লীগ কেন এই আইনের বিরোধিতা করেছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তারা মন্দ উদ্দেশ্যে আইনটি করেছিল। বিরোধীদের দমনের জন্য আইনটি পাশ করেছিল। আমরা কোনোভাবেই এই আইনের অপপ্রয়োগ করিনি।”
কী এই আইন?
অষ্টম জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের তীব্র বিরোধিতার মধ্যেই দ্রুত বিচার আইন পাশ করে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয় বিএনপি-জামায়াত সরকার।
আইনটির যথার্থতা নিয়ে তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিচার বিভাগের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অপরাধীরা জামিনে ছাড়া পেয়ে তাদের অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যায়। মামলা বছরের পর বছর চলে, এভাবে বিচারপ্রার্থীরা সুবিচার থেকে বঞ্চিত হন।
দ্রুত বিচার আইনে মামলা দায়েরের সাত দিনের মধ্যে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার বিধান আছে। আদালত আসামিকে আত্মপক্ষ সমর্থন সাপেক্ষে ৩০ থেকে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলার রায় দেবে। আসামি গ্রেপ্তার না হলে তার অনুপস্থিতিতেই চলবে বিচার।
আইনটি প্রথমে দুই বছরের জন্য করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বিএনপির মেয়াদকালে প্রতি দুই বছর পরপর সংসদে আইনটির সংশোধনী পাশ করে মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ সরকার এই আইনের মেয়াদ পাঁচ বছর পর পর বৃদ্ধি করে।
আদালত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত বিচার আইনে দায়ের মামলাগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয় না। পুলিশ সময় মতো তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারে না, আবার সাক্ষী পাওয়া যায় না। তখন বিচারক মামলাটি শেষ করার মেয়াদ বাড়িয়ে দেন।
সাধারণ মানুষ ‘হয়রানির শিকার হয়’
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “এই আইনটি দেশের স্বার্থে একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সীমিত সময়ের জন্য পাশ করা হয়েছিল। অগণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকার দ্রুত বিচার আইনটিকে নিজের ইচ্ছা মতো ব্যবহারের জন্য স্থায়ী রূপ দিচ্ছে। এর উদ্দেশ্য একটিই—বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন করা, নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা।”
২০০২ সালে বিএনপি যখন দ্রুত বিচার আইনটি করে তখন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এর “তীব্র বিরোধিতা করেছিল,” বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা মুজিবুল হক চুন্নু।
তিনি বলেন, তখন আওয়ামী লীগ বলেছিল “এই আইন একটি কালো আইন। যদি কালো আইন হয়, তাহলে তারা ২০০৯ সাল থেকে বিলটির মেয়াদ পাঁচ বছর পর বৃদ্ধি করল কেন? এখন তারা বিলটিকে চিরস্থায়ী রূপ দিচ্ছে কেন?”
তিনি বলেন, “আইনমন্ত্রী সংসদে আমার প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বিএনপি খারাপ আর আওয়ামী লীগ ভালো সে জন্যই তারা আইনটির অপব্যবহার করছেন না। কথাটা দেশের মানুষ বিশ্বাস করে না।
“বিএনপি আমলে করা আইনটিতে মজা পেয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। মনে করছে তারা সারা জীবন ক্ষমতায় থাকবে। তারা বিএনপির করা আইন বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে,” যোগ করেন তিনি।
চুন্নু বলেন, “আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে যে, তারা চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে না। তারা যখন ক্ষমতায় থাকবে না, তখন তাদের বিরুদ্ধে এই আইনের অপপ্রয়োগ হবে।”
আইনটির আপত্তিকর দিক সম্পর্কে জানতে চাইলে চুন্নু বলেন, এই আইনে মামলা হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা হয়ে যায় এবং আসামি দোষী হোক বা না হোক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করে।
তিনি বলেন, দ্রুত বিচার আইনে দায়ের মামলাগুলো ৩০ থেকে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করার বিধান থাকলেও বিচারক প্রয়োজন মনে করলে সময় বাড়াতে পারেন এবং এর কোন সীমা নেই, তাহলে লাভ কী হলো! এর মাধ্যমে অপরাধীরা যতটুকু সাজা পায় তার চেয়ে সাধারণ মানুষ বেশি হয়রানির শিকার হয়।
“বিচার কি সময় ধরে করা যায়? তাড়াতাড়ি বিচার করলে বিচারিক প্রক্রিয়ায় ভুল হয়। হয় অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায় অথবা নিরীহ ব্যক্তি সাজা পান। কোনোটিই আইনের শাসনের উদ্দেশ্য নয়,” যোগ করেন তিনি।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেন, “মূল কথা হলো বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো তফাৎ নেই। তারা একই কায়দায় সরকার চালায়। বিএনপি দ্রুত বিচার আইন করেছে। আওয়ামী লীগ সেটি বহাল রেখেছে।”
চুন্নু বলেন, “বিএনপি র্যাব বানাল, আওয়ামী লীগ বিরোধিতা করল। আবার ক্ষমতায় এসে সেই র্যাবকে বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবহার করল। আওয়ামী লীগের বিরোধিতার মধ্যেই বিএনপি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন করল। ক্ষমতায় এসে আওয়ামী সেই আইনটি বাতিল না করে এর আওতায় অপরাধের সাজা বৃদ্ধি করল। তাহলে তাদের মধ্যে তফাৎ কী?”
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে দ্রুত বিচার আইন করা হয়। তবে ২২ বছর আগে দ্রুত বিচার আদালত প্রতিষ্ঠা করা হলেও বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা দূর করা যায়নি। এই আইন দিয়ে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা যায়নি।”
তিনি বলেন, “এই প্রেক্ষাপটে যদি আইনটিকে স্থায়ী রূপ দেওয়া হয়, তাহলে আইনটি পাশের ব্যাপারে প্রশ্ন উঠবে এবং মানুষ সন্দেহ করবে যে, আইনটি হয়তো বেছে বেছে প্রয়োগ করা হবে। আবার বিরোধীরা বলবে বিরোধীদলকে দমন করতে প্রয়োগ করা হবে।”
তিনি বলেন, “দ্রুত বিচারকে স্থায়ী করায় হতে পারে যে, সব মামলাই দ্রুত বিচার আইনের অধীনে দায়ের করা হতে পারে। তখন অনেক বিচারক বিচার দ্রুত করার জন্য তাড়াতাড়ি মামলা শেষ করবেন এবং নিজেদের বাহবা নেওয়ার জন্য কাজ করবেন। ফলে মানুষ ন্যায় বিচার পাবে না।”