দেশে সোয়া লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ

আহম্মদ ফয়েজ
2022.08.12
ঢাকা
দেশে সোয়া লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ঢাকার মতিঝিল এলাকার সোনালী ব্যাংক থেকে সেবা নিচ্ছেন গ্রাহকরা। ১২ জুলাই ২০২২।
[বেনারনিউজ]

চলমান অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেই জানা গেলো চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ সর্বকালের সর্বোচ্চ এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এক বছর আগের তুলনায় এটি বেড়েছে ২৬ দশমিক ৩ ভাগ।

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণসংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা।

মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপির পরিমাণ জুন শেষে ৬২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলিতে এই ধরনের ঋণের পরিমাণ জুন মাসে দাঁড়িয়েছে ৫৫ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা।

এ ছাড়া বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ২০০৯ সালের শুরুতে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০২০ সালে একই সরকার জাতীয় সংসদে ঋণ খেলাপির তালিকা প্রকাশ করে। তখন এর পরিমাণ ছিল এক লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। এরপর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রকাশ করা হলেও ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করা হয় না।

সংসদে অর্থমন্ত্রীর দেওয়া ওই তালিকা অনুযায়ী, দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপি গ্রাহক ছিল অ্যাননটেক্স, এরপরই ক্রিসেন্ট গ্রুপ। এ প্রতিষ্ঠান দুটি রাষ্ট্র মালিকানাধীন জনতা ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়। প্রতিষ্ঠান দুটিই ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, আবার ব্যাংকের ঋণও শোধ করেনি। অ্যাননটেক্সের মালিক ইউনুছ বাদল দেশের বাইরে।

১১শ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা পৃথক চার মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ কাদেরকে ২০২০ সালে জামিন দেন আদালত।

এ ছাড়া খেলাপির শীর্ষ তালিকায় আরও ছিল বিল্ডট্রেড গ্রুপ ও চ্যানেল নাইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েতুর রহমান। তাঁর কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত ব্যবসায়ী মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, নর্থ বেঙ্গল পোলট্রিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এ দুই গ্রাহকই নামে বেনামে বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বের করে নেন। গত কয়েক বছর ধরে মিঠু দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।

উচ্চমাত্রার ঋণ খেলাপির ঘটনা উদ্বেগজনক

উচ্চমাত্রার ঋণ খেলাপির ঘটনাকে উদ্বেগজনক আখ্যায়িত করে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ব্যাংকিং খাতের বড়ো দুর্বলতা নির্দেশ করে।

তাঁরা মনে করেন, খেলাপিদের মোকাবেলা করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবিলম্বে ব্যাংকিং খাতে কর্পোরেট গভর্ন্যান্স উন্নত করা উচিত।

এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।”

তিনি বলেন, সম্প্রতি খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এর ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসবে।

অবশ্য শর্ত শিথিল করে ব্যাংকগুলোকে দেয়া সুযোগ অর্থনীতিতে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন না বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

বেনারের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, “এসব শর্ত দিয়ে যদি খেলাপি ঋণ কমেও আসে, তাতে এর মানে এই নয় যে ব্যাংকগুলোতে টাকা ঢুকবে। শুধু কাগজে কলমে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার এসব উদ্যোগ অর্থনীতির জন্য মোটেও ইতিবাচক নয় বরং কাউকে কাউকে অন্যায্য সুবিধা দিতে পারে।”

গত মাসে, খেলাপি ঋণ ঠেকাতে বড়ো ছাড় দিয়ে নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ঋণ আদায় না বাড়লেও সাময়িকভাবে কমবে খেলাপি ঋণ।

নতুন নীতিমালার ফলে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। পাশাপাশি এসব ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধ করা যাবে। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। আবার নতুন করে ঋণও পাওয়া যাবে।

এ সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এই নীতিমালা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত।

এর আগেও করোনার ফলে লোকসানে পড়া ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়াতে ঋণ পরিশোধে ছাড় দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তাতেও কোনো সুবিধা হয়নি দাবি করে অর্থনীতিবিদ জাহিদ বলেন, এসব করে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়।

জাহিদ মনে করেন, এভাবে ঋণ খেলাপিরা সুবিধা পেতে থাকলে চলমান ডলার সংকট আরো বাড়বে।

তাঁর এই বক্তব্যের যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, “ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে টাকা ফেরত দিতে পারেন না দাবি করলেও, আমরা দেখি কীভাবে দেশের টাকা নানা উপায়ে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই পাচার হওয়া টাকা কিন্তু ডলার হয়েই বিদেশ যাচ্ছে, ফলে দেশের ডলার কিন্তু বিদেশে যাচ্ছেই।”

তাঁর মতে, বেশিরভাগ খেলাপিরা ইচ্ছা করেই খেলাপি হন।

বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি বা ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) গত ৩১ মে বাংলাদেশ ব্যাংককে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ স্থগিতের সুবিধা বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করেছিল।

এফবিসিসিআইয়ের অনুরোধের প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২৩ জুন ঋণগ্রহীতাদের চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের ঋণের কিস্তির ২৫ থকে ২৭ শতাংশ পরিশোধ করে খেলাপি হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ হওয়া এড়াতে সুযোগ দিয়েছে।

কোভিড মহামারির কারণে ২০২০ সালে ঋণগ্রাহকদের ঋণের টাকা ফেরত দিতে হয়নি। কিন্তু ২০২১ সালে, তাঁদের খেলাপি হওয়া এড়াতে ঋণের মাত্র ১৫ শতাংশ পরিশোধ করতে বলা হয়েছিল।

সুবিধা পায় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা

খেলাপি ঋণের শর্ত শিথিল করে দিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর অপব্যবহার হয় এবং সুযোগ নেয় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, এমনটি মনে করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার।

তিনি মনে করেন, “এসব অন্যায্য সুবিধার ব্যবহার বেশিরভাগ সময়ে যেমন রাজনৈতিক হয়, তেমনই যারা নিয়মিত ঋণ শোধ করেন তাঁরাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।”

তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তি যদি ঋণ খেলাপি হন তবে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য হয়ে পড়েন, ফলে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের লোকদের নির্বাচনে যোগ্য রাখতেও এসব সুবিধা নিয়ে থাকে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।