শেষ দিনেও মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি ১৭ হাজার কর্মী, পৌঁছার পরও কর্মহীন অনেকে

জেসমিন পাপড়ি
2024.06.03
ঢাকা
শেষ দিনেও মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি ১৭ হাজার কর্মী, পৌঁছার পরও কর্মহীন অনেকে পরিবারের সচ্ছলতার জন্য মালয়েশিয়া যেতে চেয়েছিলেন নাটোরের মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ। কিন্তু সব কাগজ প্রস্তুত হলেও শেষ পর্যন্ত বিমানের টিকিট না পাওয়ায় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। ৩১ মে ২০২৪।
[মেহেদী রানা/বেনারনিউজ]

ধানের জমি বন্ধক রাখার পাশাপাশি সুদে ঋণ নিয়ে প্রায় ছয় লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ময়মনসিংহের আনোয়ার হোসেন। মাস দেড়েক আগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ভিসাসহ চূড়ান্ত ছাড়পত্র পান তিনি। কিন্তু বিমানে টিকিটের অভাবে মালয়েশিয়া যাওয়া হয়নি তাঁর।

গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন আনোয়ার। বিদেশ যাওয়ার আশায় চাকরিও ছেড়ে দেন কিন্তু মালয়েশিয়া যেতে পারলেন না, উল্টো ঋণের সুদ বাড়ছে। এখন বেকারত্ব আর টাকা ফেরত পাওয়ার অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটছে তাঁর।

“রিক্রুটিং এজেন্সি টাকা ফেরত না দিলে পথে বসতে হবে। শেষ দিনেও তারা টিকিটের জন্য অতিরিক্ত ৩০ হাজার টাকা নিয়েছে। মালয়েশিয়া যাওয়ার আশায় সুদে ধার নিয়ে সেই টাকা দিয়েছি। শেষ দিন (৩১ মে) পর্যন্ত আশা ছিল টিকিট মিলবে। কিন্তু দালাল আমাকে ভুয়া টিকিট ধরিয়ে দেয়,” সোমবার বেনারকে বলেন আনোয়ার।

“মালয়েশিয়া যাওয়া তো হলো না। এখন আমরা রাস্তার ফকির। কীভাবে চলব, কিছুই জানি না,” বলেন তিনি।

সব প্রক্রিয়া শেষে চূড়ান্ত ছাড়পত্র নিয়েও আনোয়ারের মতো ১৬ হাজার ৯৭০ বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। এদের কেউ কেউ বিমানের টিকিট সংগ্রহ করতে পারেননি, কারো আবার মালয়েশিয়া থেকে নিয়োগকর্তার চূড়ান্ত সম্মতি আসেনি।

পৌঁছালেও কাজ নেই

অন্যদিকে অনেক চেষ্টা করে মালয়েশিয়ায় পৌঁছালেও সেখানে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন নতুন করে প্রবেশ করা বাংলাদেশি কর্মীদের অনেকেই। কোম্পানি ভিসায় গিয়ে জানতে পারছেন সেখানে কাজ নেই।

চারদিন আগে মালয়েশিয়া পৌঁছান মাগুরার রফিকুল ইসলাম। তিনদিন কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরেই ছিলেন। তিনদিন পর কোম্পানির লোক পরিচয়ে তাঁকে রিসিভ করে নেওয়া হয় একটি বাসায়। দুই রুমের ওই বাসায় তাঁর মতো অন্তত ৮০ জন রয়েছে বলে টেলিফোনে বেনারকে জানান রফিকুল।

সেখানে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশ থেকে টাকা ভাঙিয়ে দেড়শ রিঙ্গিত নিয়ে এসেছিলাম। তিনদিন এয়ারপোর্টে থেকে সেটা খরচ হয়েছে। আজ এখানে এলাকার এক ভাই আমাদের দেখতে এসে ৩০ রিঙ্গিত দিয়ে গেছেন, সেখানে থেকে ১০ রিঙ্গিত দিয়ে ভাত খেয়েছি। বাকি ২০ রিঙ্গিত ফুরিয়ে গেলে কী হবে জানি না।”

রফিকুল বলেন, “এসেছিলাম কোম্পানি ভিসায়। আসার পরে জানতে পারছি এজেন্ট ভিসা। মানে কোম্পানির নামে মূলত এজেন্ট আমাদের নিয়ে এসেছে। আসার পরেই আমাদের সবার কাগজপত্র তারা নিয়ে নিয়েছে। কাল-পরশু মেডিকেল করানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে মেডিকেল করার পরে নিজেদের কাজ খুঁজে নিতে বলেছে।”

এলাকায় কৃষি কাজ করা রফিকুল বলেন, “কখনো ঢাকা শহরে কাজ খুঁজতে যাইনি। এখন আমি মালয়েশিয়ায় কীভাবে কাজ খুঁজে পাব? চারদিকে অন্ধকার দেখছি।”

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার শামীম আহসান সোমবার বেনারকে বলেন, ৩১ মে রাতে বাংলাদেশ থেকে সর্বশেষ ফ্লাইট কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে পৌঁছায়। শেষ দিকে বিভিন্ন দেশ থেকে কর্মীরা প্রবেশ করায় স্বাভাবিকভাবে বিমানবন্দরে বেশ ট্রাফিক ছিল। তবে গতকাল (রবিবার) সকল বাংলাদেশি কর্মী বিমানবন্দর ছেড়েছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি।

কর্মীদের কাজ না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যারা এদেশের এসে পৌঁছেছেন তাদের কাজ না পাওয়ার কারণ নেই। তাছাড়া যারা চূড়ান্ত ছাড়পত্র পেয়ে আসতে পারেননি, বিশেষ বিবেচনায় তাদের আনার জন্য আমরা কূটনৈতিকভাবে মালয়েশিয়ার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।”

মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী কর্মীদের মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সর্বশেষ সময় ছিল ৩১ মে।

এ প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ কর্মীর ছাড়পত্র নেয়। এর মধ্যে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন। বাকি প্রায় ১৭ হাজার কর্মী যেতে পারেননি।

যেসব বাংলাদেশি কর্মী ছাড়পত্র পাওয়ার পরেও যেতে পারেননি তাঁদেরকে বিশেষ বিবেচনায় আসার সুযোগ দেয়া হবে কি না জানতে বেনারনিউজের পক্ষ থেকে সোমবার মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও অভিবাসন দপ্তরে যোগাযোগ করে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

IMG_1726.jpg
মালয়েশিয়ায় যাওয়ার শেষ দিনে বিমানের টিকিট পাওয়ার আশায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছেন শ্রমিকরা। ৩১ মে ২০২৪। [মেহেদী রানা/বেনারনিউজ]

 ‘ভয়ঙ্কর দুর্বৃত্তপনা

মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশি কর্মীরা জানিয়েছেন, হাজার হাজার কর্মীদের কোনো কাজ নেই। না খেয়ে কাজের সন্ধানে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেকেই।

চার বছর ধরে কুয়ালালামপুরে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছেন শাহজাহান সিরাজ। তিনি বেনারকে বলেন, “নিজ দেশের ভাইদের এমন কষ্ট চোখে দেয়া যায় না। রাস্তায় রাত কাটাচ্ছেন অনেকেই।”

শাহজাহান জানান, নির্দিষ্ট কোম্পানি কাজ না দিলে এদের বেশির ভাগেরই মেডিকেল সম্পন্ন হবে না। মেডিকেল না হলে তারা এক বছরের ওয়ার্ক পারমিটের আবেদন করতে পারবেন না। যার পরিণতি কম বেতনে কাজ করা এবং শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ডিপোর্ট হওয়া।

অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারসাজির মাধ্যমে অতিরিক্ত চাহিদা দেখিয়ে কর্মী পাঠানোর ফলে এই অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

“মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানোর নামে যা হয়, তা “ভয়ঙ্কর দুর্বৃত্তপনা,” সোমবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন এ বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ ইনিশিয়েটিভস কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান।

তিনি বলেন, “গুটিকয়েক লোক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করতে গিয়ে” প্রতিবার কর্মী নেওয়ার সময় বলে নতুন সিস্টেমে লোক নেয়া হবে। “কিন্তু শেষমেশ দেখা যায় আগের বারের তুলনায় বেশি টাকা খরচ করতে হয়, আরো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।”

তবে এবারের সংকটের জন্য মালয়েশিয়া সবচেয়ে বেশি দায়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তারাই প্রথমে ২৫ টি রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। এদের মাধ্যমে কর্মীদের সরকারি ৭৯ হাজার টাকার পরিবর্তে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া যেতে হয়। এটা দুর্বৃত্তপনা। এটা তারা করতে পারে কারণ, তাদের কখনো বিচার হয় না।”

“মালয়েশিয়াও নিত্য নতুন নিয়ম চালু করে কর্মীদের সাথে প্রতারণা করে। আন্তর্জাতিকভাবে এই ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিত,” বলেন শরিফুল হাসান।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে জনশক্তি নিয়োগে অনিয়ম বিষয়ে মালয়েশিয়ার ওপর চাপ এসেছে।

তদন্ত কমিটি

চূড়ান্ত ছাড়পত্র পেয়েও মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে ব্যর্থতা, শ্রমবাজার নিয়ে দুর্নীতিসহ কর্মীদের হয়রানির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

ছয় সদস্যের কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে বলে জানান প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী।

শফিকুর রহমান চৌধুরী রোববার সাংবাদিকদের বলেন, অতিরিক্ত সচিব (কর্মসংস্থান) নূর মো. মাহবুবুল হককে প্রধান করে গঠিত এই কমিটি ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতেও কাজ করবে।

সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. রুহুল আমিন বলেন, ছাড়পত্র পেয়েও যে কর্মীরা মালয়েশিয়া যেতে পারেননি, সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের টাকা ফেরত দেবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশ থেকে কর্মী নেয় মালয়েশিয়া। অন্য দেশগুলোর সব এজেন্সি কর্মী পাঠানোর সুযোগ পেলেও বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কয়েকটি এজেন্সি নির্ধারণ করে দেয় মালয়েশিয়া।

এই প্রক্রিয়ায় টানা চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে শ্রমবাজারটি খুলতেই শুরুতে ২৫টি পরে ১০০ এজেন্সিকে এই সুযোগ দেওয়া হয়।

সরকার মালয়েশিয়া যাওয়ার খরচ কর্মী প্রতি ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার নির্ধারণ করলেও এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশটিতে যেতে পাঁচ থকে ছয় লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে প্রতি কর্মীকে।

সিন্ডিকেটের বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “যে দেশ কর্মী নেবে, তারা যদি তাদের পছন্দের রিক্রুটিং এজেন্সি দিয়ে কর্মী নিতে চায়, সেটা তাদের বিষয়। তবে সরকার চায়, সবার মাধ্যমে কর্মীরা বিদেশে যাক।”

তবে শিগগির মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রতিমন্ত্রী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।