অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পর বিমান ভাড়া কিছুটা কমলেও বেকায়দায় প্রবাসী শ্রমিকেরা
2022.01.11
ঢাকা

দেশি-বিদেশি বেসরকারি কোম্পানির মতো রাষ্ট্রীয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও টিকেটের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানোয় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরা।
সাধারণ অবস্থায় যেখানে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকায় আসা-যাওয়ার টিকেট পাওয়া যেত, সেই একই গন্তব্যে একমুখী টিকেট দ্বিগুণের বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
সমালোচনার মুখে বিমান ঘোষণা দিয়ে ভাড়া কমালেও তা এখনও অস্বাভাবিক বলে মনে করেন যাত্রী, ট্রাভেল এজেন্ট এবং অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উপ-মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “গত ৪ জানুয়ারি রেমিটেন্স যোদ্ধা প্রবাসীদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইটের টিকেটের মূল্য কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। এই সিদ্ধান্ত ১৬ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।”
তিনি জানান, ঢাকা-জেদ্দা রুটে ইকোনমি শ্রেণীর প্রতিটি টিকেটের একমুখী সর্বোচ্চ ভাড়া ট্যাক্সসহ ৭২ হাজার ৪৫৫ টাকা থেকে কমিয়ে ৬৪ হাজার ৮২০ টাকা, ঢাকা-রিয়াদ/দাম্মাম রুটে ইকোনমি ক্লাসের একমুখী সর্বোচ্চ ভাড়া ট্যাক্সসহ ৭০ হাজার ৭৫৮ টাকা থেকে কমিয়ে ৬৩ হাজার ১২৩ টাকা করা হয়েছে।
এছাড়া, ঢাকা-দুবাই রুটে ইকোনমি ক্লাসের একমুখী সর্বোচ্চ ভাড়া ট্যাক্সসহ ৭৫ হাজার ৫০৮ টাকা থেকে কমিয়ে ৬২ হাজার ৭৮৪ টাকা, ঢাকা-আবুধাবি রুটে ইকোনমি ক্লাসের একমুখী সর্বোচ্চ ভাড়া ট্যাক্সসহ ৬৭ হাজার ২৫ টাকা থেকে কমিয়ে ৫৮ হাজার ৫৪২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
‘টিকেট নেই, দাম কমিয়ে লাভ কী?’
বিমানের এই ভাড়া কমানো সিদ্ধান্তে তেমন লাভ হবে না বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকার বনানীতে অবস্থিত হলিডে ট্রাভেল এজেন্সির স্বত্বাধিকারী কামরুল ইসলাম মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “বিমান টিকেটের যে দাম কমিয়েছে এটি লোক দেখানো। কারণ আগামী প্রায় তিন মাসের সব টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। ১৬ জানুয়ারি থেকে টিকেট কিনতে গেলে কেউ টিকেট পাবে না। টিকেটই যখন নেই, তখন দাম কমিয়ে লাভ কী?”
“গত দুই মাস থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গন্তব্যে বিশেষ করে সৌদি আরবের টিকেটের ব্যাপক চাহিদা। সাধারণ সময়ে যখন ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় দুইমুখী টিকেট কেনা যায় সেই গন্তব্যে একমুখী ভাড়া ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে,” বলেন কামরুল।
“মানুষও বাধ্য হয়ে কিনেছে। কারণ টিকিট না পেলে চাকুরি থাকবে না,” বলেন তিনি।
কামরুল আরও বলেন, “এর পেছনে বিমানের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কিছু অসাধু ট্রাভেল এজেন্টদের যোগসাজশ থাকতে পারে। টিকেট বিক্রি শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রাভেল এজেন্টগুলো গ্রুপ টিকেট কিনে নেয়। ফলে সাধারণ মানুষ আর টিকেট পায় না। তখন গ্রুপ টিকেট হিসাবে টিকেটগুলো বেশি দামে বিক্রি করা হয়।”
তিনি বলেন, “এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে বিমান কর্তৃপক্ষের উচিত গ্রুপ টিকেটের পরিমাণ সর্বোচ্চ ২০ ভাগ রেখে বাকী টিকেট কর্মীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া।”
হতাশ বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ মঙ্গলবার কমিটির সভা শেষে বেনারকে বলেন, “বিমানের বেশি ভাড়া আদায়ের বিষয়টি নিয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। বিমানের পক্ষ থেকে ভাড়া কমানোর কথা জানানো হয়েছে, যদিও সেটি খুব একটা কমেনি।”
তিনি বলেন, “বিদেশগামী কর্মীদের অসুবিধার কথা চিন্তা করে বিমানের ভাড়া আরও কীভাবে কমানো যায়, সেব্যাপারে কমিটি সুপারিশ করেছে।”
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, “তবে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, বিষয়টি চাহিদা ও যোগানের হিসাবে পড়ে গেছে। আমরা সুপারিশ করেছি, তবে বিমান ভাড়া কমাতে পারবে কি না সেব্যাপারে সন্দেহ আছে। কারণ চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে।”
বাড়তি এই ভাড়া সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বেনারকে মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “বিমান যেভাবে উচ্চ ভাড়া নিচ্ছে এটি ঠিক নয়। আমি বহুবার বিমানকে এই বাড়তি ভাড়া কমানোর তাগিদ দেয়ার পরও কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমি হতাশ।”
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন শাখার প্রধান শরীফুল হাসান বেনারকে বলেন, “করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমে আসায় গত দুই মাসে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক, এক লাখ ৩০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী বিদেশ গেছেন। সেকারণে উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলো টিকেটের দাম দুই-তিন গুণ বৃদ্ধি করে দিয়েছে। এমনকি আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিমানও টিকেটের দাম দুই-তিন গুণ বৃদ্ধি করেছে।”
তিনি বলেন, “দেশের অসচ্ছল এইসব মানুষের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেয়া হচ্ছে। ফলে অভিবাসন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, যদিও সরকার চেষ্টা করছে খরচ কমাতে।”
“তবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিমান এই বর্ধিত ভাড়া না নিলেও পারত। তা ছাড়া, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এই ধরণের ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে পারত,” বলেন শরীফুল হাসান।
‘টিকিটের বাড়তি খরচ কতদিনে তুলব?’
নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বাসিন্দা ও প্রবাসী সোলাইমান মিয়া মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আমরা সবাই তো কাজের জন্য বিদেশে যেতে চাই। কিন্তু বিমান ভাড়া অত্যধিক। আগে আমরা ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় ফিরতি টিকেট কিনতে পারতাম। মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো শহরে এখন একমুখী টিকেট ৯৫ হাজার টাকা।”
তিনি বলেন, “আমার এক আত্মীয় গত ৩০ ডিসেম্বর ৯৫ হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কেটে দুবাই গেছে, এটা অবিচার ছাড়া কিছু নয়।”
নারায়ণগঞ্জ শহরের বাসিন্দা ও প্রবাসী কর্মী লিটন মজুমদার বিমানে টিকেট কিনতে ব্যর্থ হয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে টিকেট কিনতে গেলে জানানো হয় ইকোনমি শ্রেণির কোনো টিকেট নেই।
চাকরি রক্ষায় লিটন বাধ্য হয়ে ৬ জানুয়ারি ঢাকা-দুবাই একমুখী বিজনেস ক্লাসের টিকেট কেনেন এক লাখ ২০ হাজার টাকায়।
তিনি বলেন, “আমরা ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় ফিরতি টিকেট কিনতে পারতাম। সেই একই গন্তব্যে আমাকে বাধ্য হয়ে এক লাখ ২০ হাজার টাকায় একমুখী টিকিট কিনতে হলো। বেতন পেয়ে বাড়িতে মাসে ২০ হাজার টাকা পাঠাতে পারি। টিকিটের এই বাড়তি খরচ কতদিনে তুলব?”
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, গত বছর জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে তিন লাখ ৭৩ হাজার কর্মী বিদেশ গেছেন। এর মধ্যে শুধু নভেম্বর ও ডিসেম্বরেই প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার কর্মী মধ্যপ্রাচ্যের দেশে কাজের জন্য বাংলাদেশ ছেড়েছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই বছর ডিসেম্বর একমাসে সর্বোচ্চ এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি কর্মী মধ্যপ্রাচ্যে মূলত সৌদি আরব গেছেন। সেকারণে হয়তো টিকেটের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
সচিব জানান, “যদি করোনাভাইরাস পরিস্থিতি খারাপ না হয় তাহলে ২০২১ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে ১০ লাখ কর্মী বিদেশে যাবেন বলে আমরা লক্ষ্য স্থির করেছি।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক তৌহিদ-উল-আহসান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, ঢাকা থেকে প্রতিদিন গড়ে সব মিলিয়ে ৫০টি ফ্লাইট যায় এবং ৪৮টি ফ্লাইট আসে। প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার যাত্রী ঢাকা ছেড়ে যান এবং প্রায় আট হাজার যাত্রী ঢাকায় অবতরণ করেন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ঢাকা-জেদ্দা, ঢাকা-রিয়াদ/দাম্মাম, ঢাকা-দুবাই, ঢাকা-আবুধাবি রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে সংস্থাটি। বিমানের প্রতি সপ্তাহে আবুধাবিতে চারটি, দুবাইয়ে সাতটি, দাম্মামে পাঁচটি, জেদ্দায় সাতটি ও রিয়াদে ছয়টি ফ্লাইট রয়েছে।