ইউরোপের দেশগুলোতে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেড়েছে

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.06.29
ঢাকা
ইউরোপের দেশগুলোতে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেড়েছে ইতালির রোমে একটি গ্যাস স্টেশনে কর্মরত একজন প্রবাসী বাংলাদেশি। গত বছর বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে যাওয়া অভিবাসীদের ৩৫ ভাগই গেছেন ইতালিতে। ৬ মে ২০২০।
[আন্দ্রেয়াস সলারো/এএফপি]

দেশে বসবাসের নিরাপত্তা নেই—এমন অভিযোগ করে গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ব্যক্তিদের ২০ হাজারের বেশি আবেদন জমা হয়েছে। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৫৭০।

বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার প্রকাশিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা সংক্রান্ত ২০২২ সালের প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশিরা ষষ্ঠ সর্বোচ্চ রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী।

গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত সিরিয়া থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ ১৭ হাজার, আফগানিস্তান থেকে এক লাখ দুই হাজার, ইরাক থেকে ৩০ হাজার, পাকিস্তান ও তুরস্ক থেকে ২৫ হাজার করে এবং বাংলাদেশ থেকে ২০ হাজার ১১০ জন রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়েছে, সেসব দেশে হয় গৃহযুদ্ধ, তীব্র অর্থনৈতিক সমস্যা অথবা নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক রয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেলেও এত-সংখ্যক রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন দেশের ভাবমূর্তির জন্য নেতিবাচক।

তাঁদের মতে, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর প্রায় সবাই অর্থনৈতিক অভিবাসী। তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে থেকে যেতে চান।

মিথ্যা কথা’ বলে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা!

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বুধবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে এমন কোনও পরিস্থিতি হয়নি যে আমাদের নাগরিকদের ইউরোপীয় ইউনিয়নে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। মিথ্যা কথা বলে সেখানে থেকে যাওয়ার জন্য এই রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা।”

তিনি বলেন, “সেখানে যাওয়ার মূল কারণ অর্থনৈতিক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই ধরনের আবেদনকে আমলে নিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান করে বিধায় অনেকে আবেদন করতে আগ্রহী হয়। তাঁরা যদি রাজনৈতিক আশ্রয় না দিত, তাহলে এমন আবেদন কেউ করত না।”

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে আলোচনা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে।

২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৮০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত পাঠানোর কথা জানায়।

প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক অভিবাসী’

আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার হিসাবে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ১৩ হাজার ৩৫৪ জন বাংলাদেশি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে গেছেন অথবা প্রবেশের চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশিরা সাগর ও সড়ক পথে ইতালি, মাল্টা, গ্রীস ও স্পেন হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করে।

এ ছাড়া পশ্চিম বলকান দেশ বসনিয়া-হারজেগোভিনা এবং ক্রোয়েশিয়া হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেন।

বাংলাদেশিরা বসনিয়ার জঙ্গলে মাসের পর মাস ধরে অবস্থান করেন এবং সেখান থেকে ক্রোয়েশিয়া হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে যান।

অভিবাসী কর্মীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান সৈয়দ সাইফুল হক বুধবার বেনারকে বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তানসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক আবেদন করেন। তাদের দেশে হয় গৃহযুদ্ধ অথবা কঠোর স্বৈরশাসন অথবা গভীর অর্থনৈতিক সমস্যা রয়েছে।”

তিনি বলেন, “কিন্তু বাংলাদেশে তেমন কঠিন সমস্যা নেই। প্রকৃত রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য যোগ্য মানুষের সংখ্যা খুব কম বলে আমি মনে করি।”

সাইফুল হক বলেন, “তারপরও বাংলাদেশ থেকে ২০ হাজারের বেশি নাগরিকের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন সত্যিই দুঃখজনক। যারা ওখানে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন তাঁরা প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক অভিবাসী।”

তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের দালালরা বাংলাদেশের যুব সমাজে একটি অংশের কাছে স্বপ্ন বিক্রি করে। তারা যুবকদের প্রলোভন দেখিয়ে বোঝায় যে, কোনোভাবে ইউরোপে পৌঁছাতে পারলেই নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে।”

সাইফুল হক বলেন, “সেকারণেই বাংলাদেশি যুবকরা ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা দালালদের দিয়ে ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যায়। সেখানে তারা আরেক দালালের পরামর্শে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে।”

তিনি বলেন, “এই রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার জন্য তারা নিজেদের বিভিন্ন বিরোধী ও প্রগতিশীল গ্রুপের সদস্য হিসাবে দাবি করে এবং বাংলাদেশে বসবাসের কোনো অবস্থা নেই বলে গুম, খুন, হত্যা, জঙ্গিবাদসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে দেশের বদনাম করে।”

সাইফুল হক বলেন, “তবে এই কাজ করে তারা যে সবসময় সফল হয় তা নয়। তাদের আবেদন বাতিলও হয়ে যায়।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ থেকে যাঁরা অবৈধভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে অবস্থান করছেন অথবা যাদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন খারিজ হয়ে গেছে, তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এসব মানুষ যাতে দেশে ফিরে কাজ করতে পারে সেজন্য একটি প্রকল্পে অর্থায়ন করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।”

৩৫ ভাগ আবেদন ইতালিতে

স্বতন্ত্র অভিবাসী বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার কর্মকর্তা আসিফ মূনীর বুধবার বেনারকে বলেন, “ইউরোপীয় দেশগুলোতে আগে থেকে যেসব মানুষ পৌঁছতে পারত, তারা কোনো না কোনোভাবে বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে অবস্থান করত।”

তিনি বলেন, “কিন্তু ২০১৩ ও ২০১৪ সালের পর থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোতে অভিবাসীবিরোধী মনোভাব শক্ত হয়েছে। দেশগুলো মনে করছে যে, বিশ্বের লাখ লাখ মানুষকে এভাবে অবৈধভাবে আর থাকতে দেয়া যায় না। সেকারণে তারা অভিবাসী আইন কঠোর করেছে।”

“এই কঠোর পদক্ষেপের ফলে যাঁরা অবৈধভাবে অবস্থান করছেন তাঁরা হয়তো দালালদের পরামর্শে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন, অনেকের আবেদন বাতিলও হয়ে যায়,” বলেন আসিফ মূনীর।

তিনি বলেন, “অনেকে স্টুডেন্টস ভিসায় গিয়ে থেকে যান; অনেকে পর্যটক হিসাবে গিয়ে থেকে যান। আবার যাদের লেখাপড়া কম তারা দালাল ধরে লিবিয়া, তুরস্ক, গ্রীস হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে যায়।”

আসিফ মূনীর বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে সব কিছু বন্ধ ছিল। সেকারণে কেউ কেউ বৈধ বা অবৈধ পথে ইউরোপে যেতে পারেনি। করোনাভাইরাস নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর সবাই সেখানে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। একারণে সংখ্যাটা বেশি হতে পারে।”

তিনি বলেন, “প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য যোগ্য মানুষ তেমন নেই বললেই চলে। তবুও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে থাকতে অনেকে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন।”

ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে আবেদনকারীদের শতকরা ৩৫ ভাগ ইতালিতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন।

এর অন্যতম কারণ হলো, দেশটির অবস্থান। কোনো কার্যকর সরকার না থাকায় লিবিয়ার উপকূল হয়ে মানবপাচারকারীদের সহায়তায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে প্রবেশ করা যায়। সেখান থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার সুযোগ থাকে।

তবে এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পারাপারের সময় অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারান, যাঁদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।