তিন বছর পর খুলছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার, সমঝোতা স্মারক সই

জেসমিন পাপড়ি
2021.12.19
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
তিন বছর পর খুলছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার, সমঝোতা স্মারক সই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেবার বিষয়ে কুয়ালালামপুরে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর করমর্দন করছেন বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ (বামে) এবং মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানান। ১৯ ডিসেম্বর ২০২১।
[সৌজন্যে: মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়]

তিন বছর বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেবার জন্য রোববার নতুন একটি সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) সই করেছে মালয়েশিয়া।

কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানান এই স্মারকে স্বাক্ষর করেন বলে কুয়ালালামপুর থেকে মুঠোফোনে বেনারকে জানান জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম। তিনি প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য।

“পাঁচ বছর মেয়াদী এই এমওইউ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পর বন্ধ থাকা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের দুয়ার খুলে গেলো। এটা দুদেশের জন্য দারুণ খবর। অন্য বারের তুলনায় এবারের চুক্তিতে কর্মীদের যাতায়াতসহ অনেক বিষয় স্পষ্ট করে উল্লেখ রয়েছে। ফলে অভিবাসন খরচ অনেকটাই কমে আসবে,” বলেন শহীদুল আলম।

বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেবার বিষয়ে মালয়েশিয়ার সর্বশেষ সমঝোতার মেয়াদ শেষ হয় চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি। গত ১০ ডিসেম্বর দেশটির মন্ত্রিপরিষদ আবারো বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেবার বিষয়টি অনুমোদন দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয় বলে রোববার কুয়ালালামপুর থেকে এক বিবৃতিতে জানান মালয়েশিয়া মন্ত্রী সারাভানান। তিনি জানান, নতুন চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে।

এই সমঝোতার আওতায় বাংলাদেশি কর্মীদের মালয়েশিয়ায় নেওয়া, আবাসন এবং দেশে ফেরত পাঠানোসহ মালয়েশিয়া প্রান্তের যাবতীয় খরচ নিয়োগকর্তা বহন করবেন বলে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়।

“কর্মীর প্রথমবার আসা এবং মেয়াদ শেষে দেশে ফেরার খরচ নিয়োগকর্তা বহন করবেন বলে সমঝোতায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে,” বলেন শহীদুল আলম।

বিবৃতিতে বলা হয়, “নিয়োগকর্তা নিজ খরচে মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্ট নিযুক্ত করতে পারবে। মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর বাংলাদেশি কর্মীর ইমিগ্রেশন ফি, ভিসা ফি, স্বাস্থ্য পরীক্ষার খরচ, ইনস্যুরেন্স সংক্রান্ত খরচ, কোভিড পরীক্ষার খরচ, কোয়ারেন্টিন সংক্রান্ত খরচসহ সব ধরনের ব্যয় মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা বা কোম্পানি বহন করবে।”

“নিয়োগকর্তা কর্মীর মানসম্মত আবাসন, বীমা, চিকিৎসা এবং কল্যাণ নিশ্চিত করবে। ফলে আশা করা যায়, কর্মীর অভিবাসন খরচ অনেক কমে যাবে,” বলা হয় বিবৃতিতে।

এছাড়া প্রত্যেক কর্মী মালয়েশিয়ার আইন অনুযায়ীয় কর্মকালীন দুর্ঘটনা বা শারীরিক সমস্যার ক্ষেত্রে পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ পাবেন বলেও জানায় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

আশাবাদের সাথে রয়েছে আশঙ্কাও

দীর্ঘদিন পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। তবে পূর্ব অভিজ্ঞতার থেকে শঙ্কার কথাও শোনা যায় তাঁদের মুখে।

“প্রায় তিন বছর পর বাজারটি খুলতে দুদেশ একমত হয়েছে এটা ইতিবাচক এবং সম্ভাবনার,” বেনারকে বলেন বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান।

তিনি বলেন, “মালয়েশিয়ার সাথে যখনই কোনো চুক্তি হয়, তখন বলা হয় পূর্বের করা চুক্তি ব্যর্থ হওয়ায়, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী যাওয়ায় বেশি খরচ হয়েছে বলে নতুন চুক্তি করা হচ্ছে। কিন্তু একই ধরনের গোঁজামিল বারবার হয় এবং আবার বাজারটি বন্ধ হয়ে যায়। গত দুই যুগ ধরেই এই ঘটনাই ঘটে যাচ্ছে।”

“নতুন চুক্তিতে নিয়োগকর্তারা সকল খরচ বহন করার কথা বলা হয়েছে। এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হলে পূর্বের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হবে,” মনে করেন তিনি।

কর্মী নেয়ার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে রোববার স্বাক্ষরিত স্মারকটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি। বেনারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তাৎক্ষণিক কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এনডি হল এর মতে, সমঝোতা স্মারকের বিস্তারিত জনসমক্ষে প্রচার না করার কারণে “স্বচ্ছতার অভাবে” পরবর্তীতে সমস্যা তৈরি হতে পারে।

তিনি বেনারকে বলেন, “দুই দেশের মধ্যকার সমঝোতা স্মারকে সুনির্দিষ্টভাবে কী কী বিষয়ে ঐক্যমত্য হয়েছে,” তা প্রকাশ না করায় “স্বচ্ছতার অভাবে” শ্রমিক নেবার প্রক্রিয়ায় আবারো “অবৈধ সিন্ডিকেটের ফিরে আসার” আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

“সিন্ডিকেট, অতিরিক্ত খরচের মতো পুরোনো চর্চাগুলো যেন না হয়। দুই দেশই যদি কর্মী এবং নিয়োগকর্তার স্বার্থ প্রাধাণ্য দেয় এবং মাঝখানে সিন্ডিকেট, মধ্যস্বত্বভোগী, অতিরিক্ত খরচ দূর করা যায় তাহলে ভালো কিছু আশা করা যায়,” বলেন শরিফুল হাসান।

“সফটওয়ার, রিক্রুটিং এজেন্সি পছন্দ, ডিমান্ড, বাছাই, টাকা দেয়ার উপায়সহ সকল প্রক্রিয়া মানুষকে যথাযথভাবে জানিয়ে দিতে হবে,” বলেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান।

তাঁর মতে, মালয়েশিয়া যাবার ক্ষেত্রে “কর্মীদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। বাজার খুলছে বলেই টাকা দেওয়া শুরু না করে জেনে ও বুঝে পদক্ষেপ নিতে হবে।”

“আমরা চাই কর্মীরা যেন কম টাকায় মালয়েশিয়া যেতে পারেন। পাশাপাশি সকল রিক্রুটিং এজেন্সিই কর্মী পাঠাতে সক্ষম হন,” মন্তব্য করে চুক্তি স্বাক্ষরের একদিন আগে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ বেনারকে বলেন, “তবে কোনোভাবেই সিন্ডিকেট এবং উচ্চ অভিবাসনমূল্য গ্রহণযোগ্য নয়।”

এই চুক্তির আওতায় মালয়েশিয়ায় সকল খাতে বাংলাদেশি কর্মীরা যেতে পারবেন বলে জানান তিনি।

নতুন সমঝোতা অনুযায়ী পাঁচ বছরে ঠিক কত কর্মী পাঠানো সম্ভব হবে তার নির্দিষ্ট সংখ্যা ঠিক হয়নি জানিয়ে শহীদুল আলম বলেন, “বিভিন্ন খাতে তাদের চাহিদা অনুযায়ী কর্মী নেবে মালয়েশিয়া। সংখ্যা নির্ভর করবে তাদের চাহিদা আর আমাদের যোগানের ওপর।”

আদর্শ কাঠামো তৈরির সুযোগ

এর আগে পাঁচটি খাতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সমন্বয়ে জিটুজি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) প্লাস পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে ২০১৬ সালে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছিল মালয়েশিয়া। পাঁচ বছর মেয়াদী ওই চুক্তির আওতায় লোক পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সিকে।

কিন্তু প্রবাসী এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগসাজশে একটি চক্র ওই ১০ এজেন্সিকে নিয়ে সিন্ডিকেট করে শ্রমিকদের কাছ থেকে দুই বছরে ২০০ কোটি রিঙ্গিত হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।

এরপর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে বাংলাদেশি কর্মীদের আর ভিসা দেয়নি মালয়েশিয়া। তবে আগে ভিসা পাওয়া কর্মীরা যাবার সুযোগ পান। কোভিড-১৯ মহামারির দাপট কিছুটা কমলে আবারও বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিতে সম্মত হয় মালয়েশিয়া।

নতুন সমঝোতা স্মারক সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, “এটি স্বাক্ষরের ফলে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং প্রত্যাবাসনের একটি আদর্শ কাঠামো তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।”

“উভয় দেশের আইন, বিধি, প্রবিধান, জাতীয় নীতি এবং নির্দেশাবলীর আলোকে এই সমঝোতা স্মারকে কর্মীদের অধিকার ও মর্যাদাকে অধিকতর সুরক্ষিত করা হয়েছে,” বিবৃতিতে বলা হয়।

এতে বলা হয়, এই সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী বাংলাদেশের পাঠানো বৈধ রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলোর তালিকা থেকে নিয়োগকারী মালয়েশিয়ার বিধি অনুযায়ী বাংলাদেশি এজেন্ট বেছে নেবেন। এ বিষয়ে মালয়েশীয় সরকার স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করবে বলে সমঝোতা স্মারকে উল্লেখ করা হয়েছে।

চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়াতে ৩ লাখ ২৬ হাজার ৬৬৯ জন বাংলাদেশি বৈধ শ্রমিক কর্মরত ছিলেন বলে বিবৃতিতে জানিয়েছেন সারাভানান, যাদের মধ্যে প্রায় এক লাখ ৩৭ হাজার নির্মাণ খাতে ও প্রায় এক লাখ ১২ হাজার কর্মরত রয়েছেন বিভিন্ন ধরনের উৎপাদন খাতে।

গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মুনিরুছ সালেহীন বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসায় ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই আড়াই লক্ষাধিক কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে বিদেশে। এর মধ্যে গত নভেম্বর মাসে ১ লাখ ২ হাজার ৮৬৩ জন কর্মী বিদেশে গেছেন।

বিদেশ গমনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে এ অর্থবছরে সাত থেকে আট লাখ লোকের বিদেশে কর্মসংস্থান হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

প্রতিবেদনটিতে কুয়ালালামপুর থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন রে শেরমান ও নিশা ডেভিড।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।