ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি প্রবেশের সময় ২৩০ বাংলাদেশি আটক
2024.07.15
ঢাকা
ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া ও পার্শ্ববর্তী তিউনিসিয়া হয়ে ইতালি প্রবেশের চেষ্টাকালে আটক হয়েছেন কমপক্ষে ২৩০ বাংলাদেশি। এটিই হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে ইতালি প্রবেশকালে সবচেয়ে বড়ো বাংলাদেশি আটকের ঘটনা।
লিবিয়া ও তিউনিসিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ খায়রুল বাশার সোমবার বিষয়টি বেনারের কাছে নিশ্চিত করে বলেছেন, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম’র সহায়তায় আটকদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।
এদিকে মানব পাচারকারীদের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার পথে আলজেরিয়ার একটি মরুভূমিতে রাতুল খালাসী (২৩) নামে মাদারীপুরের এক যুবক প্রাণ হারিয়েছেন বলে পরিবারের সদস্যরা বেনারের কাছে নিশ্চিত করেছেন।
‘কারো কাছেই পাসপোর্ট নেই’
রোববার তিউনিসিয়ায় গিয়ে সেখানে সম্প্রতি আটক ৩০ বাংলাদেশির সাথে কথা বলেছেন জানিয়ে রাষ্ট্রদূত খায়রুল বাশার বলেন, “তারা সবাই মানবপাচারকারীদের ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে মাসের পর মাস ধরে ইতালি প্রবেশের চেষ্টা করছিল।”
আটকদের বেশিরভাগের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর গত এক বছরে এক হাজার ৮০০ বাংলাদেশিকে আইওএম’র সহায়তায় বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছেন।
“এভাবে প্রায় প্রতিদিন শুধু অবৈধ অভিবাসীদের ফিরিয়ে আনতে তদবির করে চলেছি।… এদের জন্য দেশের মর্যাদা নষ্ট হচ্ছে,” বলেন রাষ্ট্রদূত।
তিনি জানান, অবৈধভাবে ইতালি যাত্রীদের অধিকাংশই ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে বিমানে লিবিয়ার বেনগাজীতে যান। সেখানে যেতে কোনো ভিসা লাগে না। “সেখানকার বিদ্রোহী সরকার মাথাপিছু ৫০০ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে একটি সিল দিয়ে দেয়।”
এর পর তাঁরা “মানবপাচারকারীদের সাহায্যে” বেনগাজী থেকে ত্রিপলি বা লিবিয়ার গাদামাস গিয়ে সেখান থেকে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করে। আবার কেউ কেউ তিউনিসিয়া এবং আলজেরিয়ায় গিয়ে সেখান থেকে নৌকায় করে ইতালি যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে, জানান তিনি।
তিউনিসিয়ায় আটক বাংলাদেশিদের কারো কাছেই পাসপোর্ট নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা দূতাবাসের পক্ষ থেকে তাদের জন্য আউটপাশ প্রদান করব, যাতে তারা দেশে ফিরে যেতে পারে।”
মরুভূমিতে প্রাণ গেল রাতুলের
মানব পাচারকারীদের সহায়তায় গত বছর আগস্ট মাসে লিবিয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানাধীন কবিরাজপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত মুজরাইকান্দি খালাসিবাড়ী গ্রামের রাতুল খালাসী।
পুরো প্রক্রিয়ায় সাড়ে ১৭ লাখ টাকা খরচ হলেও ইতালি যাওয়া হয়নি তাঁর, মারা গেছেন আলজেরিয়ার একটি মরুভূমিতে।
রাতুলের বড়ো ভাই সুমন খালাসী বেনারকে বলেন, তাঁর বাবা আইয়ুব আলী খালাসী একজন কৃষক। তাঁরা তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রাতুল সবচেয়ে ছোট। রাতুল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে লেখাপড়া বন্ধ করে দেন।
রাতুলের কয়েকজন বন্ধু মানবপাচারকারীদের টাকা দিয়ে ইতালি পৌঁছে গেছেন জানিয়ে সুমন বলেন, এটি দেখে এবং দালালদের প্ররোচনায় সেও ইতালি যাওয়ার বায়না শুরু করে। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা তাঁকে পাঠাতে চায়নি।
তিনি বলেন, “সে শুধু কান্নাকাটি করত। দিনের পর দিন তার দাবি জোরদার হতে থাকে। অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে। এই অবস্থায় স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে রাতুলকে ইতালি পাঠাতে রাজি হন বাবা-মা।”
সুমন বলেন, রাতুল লিবিয়া পর্যন্ত পৌঁছালে আট লাখ টাকা এবং এরপর ইতালি যাওয়ার নৌকায় উঠতে আরও চার লাখ টাকা দেয়া হবে বলে দালালের সাথে তাঁদের চুক্তি হয়।
“গত বছর আগস্ট মাসে সে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া যায়। সেখানে আটক ছিল। দালালরা এসে জানায়, আরও পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে। না হলে নৌকায় ওঠা যাবে না,” বলেন সুমন।
দালালকে আরো পাঁচ লাখ টাকা দেবার পর রাতুলসহ আরও চার বাংলাদেশিকে একসাথে লিবিয়া থেকে তিউনিসিয়ায় পাঠিয়ে দালালদের একটি ঘরে আটকে রাখে জানিয়ে সুমন বলেন, “কয়েক মাস ঘোরানোর পর প্রথমে ৫০ হাজার এবং পরে আরও দুই লাখ টাকা নেয় তারা।”
সুমন জানান, ওই ঘরে মোট ছয়জনের মধ্যে রাতুলসহ চারজন বাংলাদেশি ছিলেন। চলতি বছরের জুনের কোনো এক সময় তিউনিসিয়ার পুলিশ সেখান রেইড দিয়ে তাদের আটক করে।
আটকের পর মাসখানেক কারাগারে রেখে তিউনিসিয়ার পুলিশ তাদের আলজেরিয়া সীমান্তে এক মরুভূমিতে ছেড়ে দেয় বলে জানান সুমন। “এর মধ্যে তার শরীরে ক্ষত হয়ে যায়, সেই ছবি আমাদের পাঠায়।”
সুমন বলেন, রাতুলের সাথে আকাশ নামে পাশের গ্রামের এক বাংলাদেশি ছিলেন। তাঁর মাধ্যমে তারা জেনেছেন, মরুভূমিতে কোনো খাবার ও পানি না খেয়ে একটানা তিনদিন হাঁটার পর সেখানে পড়ে গিয়ে রাতুল মারা যান।
“রাতুলের সঙ্গী আকাশ রাতুলের মৃত্যুর খবর তাঁর মাকে জানিয়েছে। দুইদিন আগে (শুক্রবার) আমরা আকাশের মায়ের কাছ থেকে রাতুলের মৃত্যুর খবর পেয়েছি,” বলেন সুমন।
সঙ্গীরা রাতুলের লাশ মরুভূমিতে রেখে চলে গেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, রাতুলকে ইতালি পৌঁছাতে এপর্যন্ত সাড়ে ১৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে যার মধ্যে সাড়ে ১৫ লাখ টাকা দালালদের দেওয়া হয়েছে এবং বাকি দুই লাখ টাকা রাতুলের খাবার খরচ হিসাবে দালালদের স্থানীয় এজেন্টদের দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, “আমাদের সাত কাঠা জমি ছিল। সেটি বিক্রি করেছি। আর সুদের ওপর নয় লাখ টাকা ধার নিয়েছি। প্রতি এক লাখের জন্য প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা হিসাবে সুদ দিতে হয়। প্রতি মাসে ৯০ হাজার টাকা সুদের কিস্তি টানছি। দুই মাস ধরে সুদের কিস্তি দিতে পারি না।”
“বাড়ির গরু বিক্রি করেছি। আমরা পথে বসে গেছি। এখন ছয় কাঠার বাড়িটুকু আছে। রাতুলও মরে গেল। আমাদেরও মেরে গেল,” বলেন সুমন।