হুমায়ুন আজাদ ‘হত্যা মামলা’য় ৪ জেএমবি সদস্যের মৃত্যুদণ্ড

শরীফ খিয়াম
2022.04.13
ঢাকা
হুমায়ুন আজাদ ‘হত্যা মামলা’য় ৪ জেএমবি সদস্যের মৃত্যুদণ্ড হুমায়ুন আজাদ ‘হত্যা মামলার’ রায়ের পর ঢাকার আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্তদের নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ১৩ এপ্রিল ২০২২।
[এএফপি]

মৌলবাদবিরোধী লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে দেড় যুগ আগে আক্রমণ ও ‘হত্যার দায়ে বুধবার চার জঙ্গির ফাঁসির আদেশ দিয়েছে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত।

বিচারক আল-মামুন রায়টি ঘোষণর পরপরই রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু বেনারকে বলেন, “এত বছর পর হলেও জড়িতদের সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট।

তারা নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা এবং তাদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ঢাকা মহানগরের এই সরকারি কৌঁসুলি (পিপি)।

দণ্ডপ্রাপ্তরা হচ্ছেন- মিজানুর রহমান মিনহাজ ওরফে শফিক ওরফে শাওন এবং আনোয়ারুল আলম ওরফে ভাগ্নে শহীদ, নূর মোহাম্মদ শামীম ওরফে জে এম মবিন ওরফে সাবু এবং সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে সজীব ওরফে তাওহিদ। রায়ের সময় প্রথম দুইজন এজলাসে উপস্থিত থাকলেও অপর দুই জঙ্গি পলাতক রয়েছে।

পর্যবেক্ষণে বিচারক জানান, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনা হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।

আসামিরা যে ধরনের জঘন্যতম অপরাধ করেছেন তা ক্ষমার অযোগ্য। তাঁদের প্রতি অনুকম্পা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই বিধায় তাঁদের সবাইকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো,” যোগ করেন তিনি।

তবে এই রায় ‘অপ্রত্যাশিত উল্লেখ করে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ এবং এম নজরুল ইসলাম বেনারকে জানান, বিচারক তাঁদের উপস্থাপিত বিষয়গুলো ভালোভাবে পর্যালোচনা না করেই এই আদেশ দিয়েছেন।

নজরুল বলেন, “হুমায়ুন আজাদ আঘাত পাওয়ার ছয়মাস পরে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। সেই মৃত্যুর দায় আসামিদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

এমন অভিযোগে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার মতো ঘটনা বাংলাদেশে নজিরবিহীন দাবি করে ফারুক বলেন, “আদালতকে আমরা বলেছি, উনার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।

ময়নাতদন্তের অনুলিপিতে হুমায়ুনের পাকস্থলীতে ‘অ্যালকোহল পাওয়া গেছে বলেও উল্লেখ করেন এই দুই আইনজীবী।

ফারুকের দাবি, হুমায়ুন আজাদের ভাষ্যানুযায়ী তাঁকে যে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেছে সে বয়সে তাঁর চেয়ে এক থেকে দেড় বছরের বড়ো। তখন স্যারের বয়স ছিল ৫৬, তাহলে যে আঘাত করেছে তার বয়স হবে ৫৭ বা ৫৮। আর সাজা পাওয়া আসামিদের বয়স ছিল তখন ২৫ থেকে ২৭।

এটাও আদালত বিবেচনায় নেননি,” বলেন তিনি।

পিপি আবদুল্লাহ বলেন, “জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে হুমায়ুন আজাদকে আঘাত করেছিল, সেই আঘাতের কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এই মামলায় ৪১ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “তাঁদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়েছে।

তবে ফারুক বলেন, “আদালতে আমরা বারবার বলেছি, যেহেতু ৩০২ ধারার মামলা, অন্তত একজন ডাক্তারকে সাক্ষী হিসেবে আনা হোক। রাষ্ট্রপক্ষ চেষ্টা করার কথা জানালেও তেমন কেউকে আনতে ব্যর্থ হয়েছে।

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে জেএমবি জঙ্গিদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হন হুমায়ুন আজাদ। পরে তিনি ২২ দিন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) এবং ৪৮ দিন ব্যাংককে চিকিৎসাধীন ছিলেন। 

একই বছরে ইন্টারন্যাশনাল পেন ক্লাবের বৃত্তি পেয়ে তিনি গবেষণার জন্য ৮ আগস্ট তিনি জার্মানির মিউনিখ শহরে পৌঁছান। এর মাত্র চারদিন পর ১২ আগস্ট নিজ অ্যাপার্টমেন্টে তাঁর নিথর দেহ মেলে।

২০০৪ সালের ১৯ আগস্ট ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “পুলিশ তাঁর মৃতদেহ অটপসি করে স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রমাণ পায়। পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মি. বিশলে জানান, ডাক্তারি পরীক্ষায় অস্বাভাবিক কিছু ধরা পড়েনি। ডাক্তাররা তাঁর “হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর লক্ষ্মণ পেয়েছেন।

রায় নিয়ে আগ্রহী নয় পরিবার

হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা হওয়ার পরদিন ঢাকার রমনা থানায় তাঁর সহোদর মঞ্জুর কবিরের দায়ের করা হত্যাচেষ্টার মামলা থেকে রূপান্তরিত এই হত্যা মামলার রায় উপলক্ষে আদালতে উপস্থিত ছিলেন না নিহতের পরিবারের কোনো সদস্য।

মামলার বাদী মঞ্জুর বেনারকে জানান, অভিযোগপত্র থেকে জামায়াতে ইসলামের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর নাম বাদ যাওয়ার পর থেকেই তারা এ ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়েছেন। যে কারণে তাদের কেউ আদালতে যাননি।

আমার ভাই যমের দুয়ার থেকে ফিরে এসে নিজে যার বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুললেন, সে দোষী প্রমাণিত না হলে সে খালাস পেত। কিন্তু তাকে অন্তত ‘চার্জশিটভুক্ত আসামি করা উচিত ছিল। পরিবারের সদস্যদের মূল আক্ষেপের জায়গা জায়গা এটাই। আমরা মনে করি, তদন্তে এটা গুরুত্ব পাওয়া উচিত ছিল,” বলেন তিনি।

এই রায় আরো আগে হলে হলে হয়তো লেখক অভিজিৎ রায়, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনসহ আরো অনেক মুক্তচিন্তার মানুষকে জঙ্গিদের হাতে মরতে হতো না,” বলেন মঞ্জুর।

মামলাটি প্রথমে পুলিশ তদন্ত করে ২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেয়। তাতে আপত্তি জানিয়ে বাদী মঞ্জুর কবির ২০০৯ সালের অক্টোবরে অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন।

সেই আবেদনে তিনি জানান, পাক সার জমিন সাদ বাদ বইটি প্রকাশের পর ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর জামায়াত নেতা সাঈদী সংসদে বইটির সমালোচনা করেন, কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা তাঁর বিষয়ে তদন্ত করেননি। অপরাধী চক্র একটি বৃত্তি দিয়ে হুমায়ুন আজাদকে জার্মানিতে নিয়ে যায়। সেখানে তিনি হত্যার শিকার হন।

পরবর্তীতে আদালত অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। সিআইডির পরিদর্শক লুৎফর রহমান মামলাটি তদন্তের পর ২০১২ সালের ১৪ মে হত্যাচেষ্টার সঙ্গে হত্যার অভিযোগ যুক্ত করে পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন।

তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায় আসামির তালিকা থেকে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীসহ আরো কয়েকজনের নাম বাদ দেওয়া হয়। ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় জেএমবি নেতা শায়খ আবদুর রহমান, আতাউর রহমান সানি, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই ও খালেদ সাইফুল্লাহর নামও বাদ দেন তদন্ত কর্মকর্তা।

দণ্ডপ্রাপ্ত চারজন ছাড়াও সেখানে হাফিজ মাহমুদ ওরফে রাকিব ওরফে রাসেলকে আসামি করা হয়েছিল। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত ২০১২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সম্পূরক অভিযোগপত্রের পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে তাদের বিচার শুরুর আদেশ দেয়।

তাদের মধ্যে নূর মোহাম্মদ শুরু থেকেই পলাতক। সালাহউদ্দিন সালেহীন ও হাফিজ মাহমুদ গ্রেপ্তার হলেও ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে তাদের ছিনিয়ে নিয়েছিল জঙ্গিরা। এর মধ্যে সালেহীন পালিয়ে যেতে পারলেও হাফিজ মাহমুদ পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

সাংস্কৃতিক লড়াই থাকলে ‘হয়তো প্রতিরোধ সম্ভব ছিল

ছড়াকার ও প্রকাশক রবীন আহসান বেনারকে বলেন, “যারা এই মতাদর্শিক হত্যাগুলোর সাথে জড়িত তারা কখনোই এটা ভাববে না যে, তাদের কতজনের ফাঁসি হয়েছে। তারা যদি আমাকে হত্যার লক্ষ্য স্থির করে তবে সুবিধাজনক সময়ে মেরে ফেলবেই। সাজার ভয় দেখিয়ে তাদের থামানো গেলে পৃথিবী আরো অনেক আগেই উগ্রপন্থা মুক্ত হতো।

“সাংস্কৃতিক লড়াইটা যদি প্রবলভাবে সক্রিয় থাকত, তাহলে হয়তো প্রতিরোধ সম্ভব ছিল। কিন্তু সেদিক থেকে দিনদিন আমরা আরো খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছি। সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে বলে যাওয়া হুমায়ুন আজাদ যতটা আশঙ্কা করতেন, তার চেয়েও নাজুক অবস্থায় পৌঁছে গেছি,” বলেন শ্রাবণ প্রকাশনীর এই স্বত্বাধিকারী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।