শীর্ষ নেতাসহ তিন জঙ্গি গ্রেপ্তার

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.07.24
ঢাকা
শীর্ষ নেতাসহ তিন জঙ্গি গ্রেপ্তার গ্রেপ্তারের পরে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার অন্যতম সদস্য মাহফুজুর রহমান বিজয়কে ঢাকায় গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে র‍্যাব। ২৪ জুলাই ২০২৩।
[সৌজন্যে: র‍্যাব]

নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার বর্তমান প্রধান (আমির) আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ (৩২) ও তাঁর দুই সহযোগীকে আটক করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

তাঁরা হলেন—কাজী সরাজ উদ্দিন ওরফে সিরাজ (৩৪) ও মাহফুজুর রহমান বিজয় (২৮) ওরফে বাবুল ওরফে জাম্বুলি।

সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এই আটকের তথ্য নিশ্চিত করেন।

তিনি জানান, বাংলাদেশ সময় সোমবার ভোররাত ৩টার দিকে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার একটি বাসা থেকে তাঁদের আটক করা হয়।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে এই জঙ্গি সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজ ও তাঁর স্ত্রীকে গ্রেপ্তারের এক মাস পর দলের প্রধানকে আটক করার ঘোষণা দিলো র‌্যাব।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) জানায়, ঢাকার ডেমরা এলাকা থেকে ২৩ জুন রাতে শামিন মাহফুজ ও তাঁর স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

র‌্যাবের ভাষ্য, শামিন মাহফুজ এই সংগঠনের উপদেষ্টা এবং এর মূল ব্যক্তি।

দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নতুন হলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া দেশের নিরাপত্তার জন্য একটি বড়ো হুমকির কারণ হতে পারে।

সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বান্দরবান জেলার পাহাড়ি অঞ্চলে গড়ে ওঠা নতুন সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এই সংগঠনের সদস্যরা।

বান্দরবান জেলায় অভিযান চালিয়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির ঘাঁটি থেকে শারক্বীয়া সদস্যদের আটক করে র‌্যাব ও নিরাপত্তা বাহিনী।

কুকি-চিন আর্মির পেতে রাখা ইম্প্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমপক্ষে চার সদস্য নিহত হয়েছেন।

সর্বশেষ ১৬ জুন মোন্নাফ হোসেন রাজু (২১) নামে এক সেনা সদস্য প্রাণ হারান বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ

স্বাধীন বাংলাদেশে উগ্রবাদী ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান মূলত ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশে ফিরে আসা কট্টর ইসলামী আদর্শের জঙ্গিদের হাত ধরে।

সোভিয়েত বাহিনীর পতনের পর আফগানিস্তানের আদলে বাংলাদেশে কট্টর ইসলামী ব্যবস্থা চালুর স্বপ্ন নিয়ে ১৯৯২ সালে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত হয় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম-বাংলাদেশ (হুজি-বি)।

শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান। তিনি বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা করেন। ওই মামলায় মুফতি হান্নানের ফাঁসি হয়েছে।

১৯৯৮ সালে গঠিত হয় জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)।

সংগঠনটির প্রধান ছিলেন শায়খ আব্দুর রহমান। এছাড়াও গঠিত হয় ছোট ছোট জঙ্গি গোষ্ঠী। সেগুলো বাংলাদেশে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।

২০০৩ সালের পর থেকে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা, নওগাঁর আত্রাই, নাটোরের নলডাঙ্গা, বগুড়ার নন্দীগ্রাম এলাকাসহ আশেপাশের গ্রামে জেএমবি’র ব্যাপক তৎপরতা শুরু হয়। এর নেতৃত্ব দেন সামরিক কমান্ডার সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই।

বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে বিরোধী পক্ষের “বাম মতাদর্শের চরমপন্থীদের” ধরে ধরে গাছে ঝুলিয়ে হত্যা করতে থাকে জেএমবি।

তবে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে বিএনপি সরকার।

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় শায়খ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত জেএমবি।

জেএমবি’র বিরুদ্ধে অপারেশন শুরু করে র‌্যাব এবং আটক হন শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাইসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতারা।

২০০৭ সালের মার্চে তাদের ফাঁসি হলে সাময়িকভাবে ভেঙে পড়ে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক। তবে ২০০৯ সালের পর থেকে পুনরায় সংগঠিত হতে থাকে আল কায়েদার আদর্শে পরিচালিত জেএমবি। গঠিত হয় আনসার আল ইসলামসহ আরও কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন।

নেতৃত্বে কোন্দলসহ বিভিন্ন কারণে জেএমবি থেকে বের হয়ে ২০১৩ সালে ইসলামিক স্টেটের আদলে গঠিত হয় নব্য-জেএমবি। শুরু হয় হত্যার মিশন।

২০১৫ সাল থেকে নব্য-জেএমবি এবং আনসার-আল-ইসলামের জঙ্গিরা দেশের ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, বিদেশি নাগরিক, অন্য ধর্মের মানুষসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর সদস্যকে টার্গেট করে হত্যা শুরু করে।

২০১৬ সালের পহেলা জুলাই ঢাকার গুলশান এলাকায় হোলি আর্টিজান ক্যাফেতে আক্রমণ করে নব্য-জেএমবির পাঁচ জঙ্গি। তারা বেছে বেছে হত্যা করে নয় ইতালিয়, সাত জাপানি, তিন বাংলাদেশি এবং এক ভারতীয় নাগরিককে।

ওই ঘটনার পর সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে পুলিশ ও র‌্যাব। জঙ্গিদের অধিকাংশই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হন অথবা বোমা ফাটিয়ে আত্মহত্যা করেন।

র‌্যাবের হিসাবে, হোলি আর্টিজান হামলার পর দুই হাজার জঙ্গিকে তারা আইনের আওতায় এনেছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “সরকার জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে; তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দিয়েছে। তবে নির্মূল করা যায়নি।”

বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা একত্রিত হয়ে ২০১৭ গঠন করে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া, যার সম্পর্কে অবগত ছিল না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

যেভাবে জানা গেলো নতুন জঙ্গি সংগঠনটি

গত বছরের ২৩ আগস্ট কুমিল্লা থেকে আট তরুণ নিখোঁজ হয়। তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হলে তদন্তে নামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

নিখোঁজ তরুণদের উদ্ধারে তৎপরতা চালানোর সময় জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে সংগঠনের অস্তিত্ব পায় র‌্যাব।

সংগঠনটির প্রধান ছিলেন মইনুল ইসলাম রক্সি। রক্সি আটক হওয়ার পর আমির হন আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। ইতোপূর্বে হুজি-বি এর সদস্য হিসেবে আটক ছিলেন মাহমুদ।

র‌্যাব জানায়, সংগঠনটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানের রুমা উপজেলাসহ আশেপাশের পাহাড়ি এলাকায় আরেক সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ’র কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।

গত বছরের অক্টোবর থেকে ওই দুই সংগঠনের বিরুদ্ধে মাসব্যাপী অপারেশন পরিচালনা করে র‌্যাব এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী।

র‌্যাবের হিসাবে জুলাই মাস পর্যন্ত জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৭৫ জন এবং কেএনএফ’র ১৭ নেতা ও সদস্যকে আটক করেছে তারা।

কতটুকু ঝুঁকিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ সোমবার বেনারকে বলেন, নতুন সংগঠনটি মূলত বিভিন্ন সংগঠনে থাকা হতাশ জঙ্গিদের নিয়ে গঠিত।

তিনি বলেন, “শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা এবং আমিরসহ শীর্ষ নেতা আটকের কারণে সংগঠনটি যে গতিতে তাদের জঙ্গিবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করছিল সেটি হবে না। তবে মনে রাখতে হবে, এই সকল সংগঠনের একজন নেতা ধরা পড়লে আরেকজন হাল ধরে। তাদের সংগঠন শেষ হয়ে যাবে না।”

মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ বলেন, “বর্তমান অবস্থায় তাদের নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই যদি না তাদের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকে।”

তিনি বলেন, “কিন্তু নির্বাচনের আগে তাদেরকে দিয়ে দেশে অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা আসতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারসহ সকলকে সচেতন থাকতে হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।