অপরাধ ঠেকাতে স্থানান্তরযোগ্য আড়িপাতা যন্ত্র কিনবে সরকার

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.06.10
ঢাকা
অপরাধ ঠেকাতে স্থানান্তরযোগ্য আড়িপাতা যন্ত্র কিনবে সরকার ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফোন ব্যবহার করছেন এক যাত্রী। ১১ এপ্রিল ২০২০।
[বেনারনিউজ]

দ্বিতীয়বারের মতো মোবাইল ফোনে আড়িপাতার স্থানান্তরযোগ্য প্রযুক্তি কিনতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্লেষকরা নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণ্ণ করতে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের আশঙ্কা করলেও সরকারের মতে প্রযুক্তিটি ব্যবহার হবে ‘অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড’ ঠেকাতে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ‘অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঠেকাতে’ অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম. মুস্তাফা কামালের সভাপতিত্বে বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এই অনুমোদন দেয় বলে সাংবাদিকদের জানান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শামসুল আরেফীন।  

এই যন্ত্র ক্রয়ে ব্যয় হবে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা। এর আগে বাংলাদেশে জঙ্গি আক্রমণ প্রতিরোধ করতে ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো এই ‘ভেহিকেল মাউন্টেড মোবাইল ইন্টারসেপ্টর’ নামক আড়িপাতা মেশিন ক্রয়ের অনুমোদন দেয় সরকার।  

সাধারণ মানুষের সাংবিধানিক অধিকার ও গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ করতে এই যন্ত্র ব্যবহৃত হবে বলে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা আশঙ্কা করলেও সরকারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হচ্ছে, সংগঠিত হওয়ার আগেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করতে এই যন্ত্র ব্যবহার করা হবে। 

এর আগে কেনা এ ধরনের যন্ত্রের মাধ্যমে অনেক নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঠেকানো এবং জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

এ প্রসঙ্গে বেনারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত সচিবের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।

“ভেহিকেল মাউন্টেড মোবাইল ইন্টারসেপ্টর কেনার মূল কারণ হলো আমাদের ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা,” বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হারুনুর রশিদ বিশ্বাস।

তিনি বলেন, “এই মেশিন দিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার আগেই তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।”

জনগণের ওপর নজরদারির অভিযোগ অস্বীকার করে হারুনুর রশীদ বলেন, “এই যন্ত্র কেনার মূল কারণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে এই যন্ত্র কেনা হচ্ছে না।” 

কথোপকথন শোনা যাবে, খুদে বার্তা দেখা যাবে

ভেহিকেল মাউন্টেড মোবাইল ইন্টারসেপ্টর প্রযুক্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তথ্য প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা বুধবার বেনারকে বলেন, ইন্টারসেপ্টর নামক এই যন্ত্রটি একটি বাহনে স্থাপন করে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া যায়।

তিনি বলেন, এই মেশিন যে স্থানে রাখা হবে সেখানকার মোবাইল টাওয়ারগুলোর মাধ্যমে ওই এলাকার সকল মোবাইল ফোনের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে এই যন্ত্র। এর মাধ্যমে মোবাইল ফোনের কথোপকথন শোনা যাবে ও খুদে বার্তা দেখা যাবে।

“এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ ও ভাইবারে কথোপকথন, খুদেবার্তা, ছবি, ভিডিও সবই দেখা সম্ভব হবে,” বলেন জোহা।

“সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিকের গোপনীয়তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের,” জানিয়ে নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “সরকার এই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন না করে উল্টো কাজ করছে।”

তিনি বলেন, “নাগরিকদের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে জনগণের গোপনীয়তাকে ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে, যা খুবই দুঃখজনক এবং এটি গ্রহণযোগ্য নয়।”

“অপরাধ দমনের কথা বলে কেনা হলেও এই মেশিন সাধারণ মানুষ ও বিরোধীদলকে দমন করতে ব্যবহার করা হবে,” বলেন বদিউল আলম মজুমদার।

এই মোবাইল ইন্টারসেপ্টর এর মাধ্যমে “জনগণের ওপর নজরদারি করা হবে। ফলে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার গোপনীয়তা বলে আর কিছু থাকবে না,” বেনারের কাছে মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

“এটিই মানতে হবে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু যারা নজরদারি করবেন তাঁদের কতটুকু ক্ষমতা দেয়া হলো, সেটি বড় প্রশ্ন। এনটিএমসি কতটুকু ক্ষমতা চর্চা করবে সেব্যাপারে কোনো নীতিমালা নেই। আমাদের নাগরিক তথ্যের সুরক্ষা আইন নেই।”

“এনটিএমসি অথবা অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে এ–সংক্রান্ত অবাধ ক্ষমতা দেওয়া উচিত হবে না,” বলেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

তাঁর মতে, “আমাদের দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা অথবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের টেলিফোন রেকর্ড করতে পারে না।”

“টেলিকমুনিকেশন অ্যাক্ট-২০০১ অনুযায়ী তদন্তকারী কর্মকর্তা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোনো গ্রাহক সম্পর্কে তথ্য নিতে পারেন। কিন্তু জনগণের ফোন রেকর্ড করার কোনো অধিকার তাঁদের দেয়া হয়নি,” বলেন বলেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। 

তবে এনটিএমসির ওয়েবসাইটের বিবরণ অনুযায়ী সংস্থাটি সরকারের নিদের্শক্রমে দেশের সকল আইনপ্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে যোগাযোগ মাধ্যমসমূহে “আইনানুগ ইন্টারসেপশন” এর সুবিধা অন্যান্য সহায়তা দিয়ে থাকে। 

কারা সরবরাহ করছে?

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বুধবারের কার্যপত্র অনুযায়ী, ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের জন্য একটি ভেহিকেল মাউন্টেড মোবাইল ইন্টারসেপ্টর ও এর সংশ্লিষ্ট সেবা ক্রয়ের জন্য সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়।

দুটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয় এবং এর মধ্যে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। দরপত্রের সকল প্রক্রিয়া শেষে সুইস প্রতিষ্ঠান তরু গ্রুপ লিমিটেড থেকে স্থানীয় এজেন্ট স্মার্ট এসসিএম সলিউশানের মাধ্যমে সাড়ে ৬৫ কোটি টাকায় মেশিনটি ক্রয়ের প্রস্তাব অনুমোদন করে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি।

সেই প্রস্তাব অনুযায়ী সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা এই প্রস্তাবটি অনুমোদন দেয়।

তবে বেনারের পক্ষ থেকে খোঁজ করে অনলাইনে তরু গ্রুপ বা স্মার্ট এসসিএম সলিউশানের নিশ্চিত কোনো ওয়েবসাইট পাওয়া যায়নি।

এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অতিরিক্ত সচিব হারুনুর রশিদ বিশ্বাস বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “দরপত্রের শর্ত পূরণ করার কারণে ওই কোম্পানিকে কাজ দেয়া হয়েছে। কোম্পানির ওয়েবসাইটে কী আছে অথবা কী নেই সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়।”

তবে দরপত্রের শর্ত অথবা কোম্পানিটি সম্পর্কে আর কোনো বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।