ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে বাগেরহাটে হিন্দু যুবক গ্রেপ্তার
2022.04.12
ঢাকা
ইসলামের নবী ও ধর্মকে নিয়ে ফেসবুকে ‘অবমাননাকর’ পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলায় মঙ্গলবার এক হিন্দু যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। একই সাথে ওই যুবকের বাড়িতে সোমবার রাতে হামলার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের আমরবুনিয়া গ্রামে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এই ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে জানিয়ে বাগেরহাটের পুলিশ সুপার কে এম আরিফুল হক বেনারকে বলেন, “প্রাথমিকভাবে সোমবার রাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ওই হিন্দু যুবককে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়। পরবর্তীতে একটি ধর্ম অবমাননার মামলা হলে যুবককে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।”
এসময় তিনি বলেন, হিন্দু পরিবারটির ওপর হামলার ঘটনায় যে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের বিস্তারিত পরিচয় এবং কারো উস্কানিতে তারা এই হামলা করেছে কিনা তা জানার চেষ্টা করছে পুলিশ।
“রমণী মোহন বিশ্বাসের ছেলে কৌশিক বিশ্বাস (২৪) নামে যে যুবককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, সে বেশ কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিল। এতে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠলে ওই যুবক তা মুছে দেয়,” বেনারকে বলেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বাগেরহাট জেলা সভাপতি শিব প্রসাদ ঘোষ।
ওই ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে সোমবার রাতে কৌশিকের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে বলে জানান তিনি।
কৌশিক অনেকদিন ধরে ভারতে ছিলেন জানিয়ে শিব প্রসাদ ঘোষ বলেন, “স্থানীয়ভাবে এই ঘটনাটি সমাধান হয়েছিল। কৌশিক ও তার পরিবার সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। কিন্তু এরপরও এমন হামলা দুঃখজনক।”
কৌশিকের বাড়িতে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত ১৭ জনসহ মোট ২০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৮০/৯০ জনকে মামলায় আসামি করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
সোমবার রাতে তারাবির নামাজের পর উত্তেজিত একদল লোক কৌশিকের বাড়িতে হামলার পাশাপাশি সর্বজনীন মন্দিরেও হামলা করে বলে জানান শিব প্রসাদ ঘোষ।
তিনি বলেন, কৌশিক কিছুদিন আগে ভারত থেকে বাংলাদেশে এলে স্থানীয় একটি মহল উত্তেজনা ছড়াতে থাকে এবং এরই এক পর্যায়ে সোমবার বিকালে স্থানীয় জিউধারা বাজারে এনে একটি সালিশ বৈঠক হয়।
“এ বৈঠকে কৌশিক বিশ্বাস ও তার বাবা রমণী বিশ্বাস নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং এ ধরনের কাজ আর না করার প্রতিশ্রুতি দেন,” বলেন শিব প্রসাদ।
মোরেলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইদুর রহমান বেনারকে বলেন, রাতে হামলার ঘটনা শোনার পর তিনি তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে গিয়ে মিছিলকারীদের ধাওয়া করেন এবং এক পর্যায়ে হামলাকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়।
তিনি আরো জানান, আটক কৌশিক ভারতে থাকাকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপত্তিকর পোস্ট দেওয়ায় সেখানেও গত বছর গ্রেপ্তার হয়ে ২৮ দিন হাজতে আটক ছিলেন।
বাগেরহাটের এই ঘটনা এমন সময় ঘটল যখন মাত্র দুইদিন আগে ক্লাসরুমে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মুন্সীগঞ্জের স্কুল শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল ১৮ দিন হাজত বাসের পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
ফেসবুক ও ধর্ম অবমাননা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে ‘ধর্ম অবমাননার’ ঘটনায় বেশ কিছু সহিংস ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের অক্টোবরে কুমিল্লায় একটি পূজামণ্ডপে কোরআন রাখার একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই ঘটনায় কমপক্ষে সাত জন নিহত হন।
কক্সবাজার জেলার রামুতে ২০১২ সালে ফেসবুকে একটি ছবি ট্যাগ করার ঘটনায় ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটে। এছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফেসবুকের মাধ্যমে ‘ধর্ম অবমাননার’ ঘটনায় সহিংস ঘটনার দৃষ্টান্ত রয়েছে ভোলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরসহ দেশের বেশ কিছু এলাকায়।
নিরাপত্তা পেলে ক্লাসে ফিরতে চান হৃদয় মণ্ডল
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তারের ১৮ দিন পর মুক্তি পাওয়া মুন্সীগঞ্জ সদরের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল বেনারকে জানান, তিনি এবং তাঁর পরিবার “নিরাপত্তা নিয়ে এখনো চিন্তিত।”
“পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে আমি ক্লাসে ফিরতে চাই,” জানিয়ে তিনি বলেন, “কোনো ধর্ম অবমাননা নয়, আমি মূলত স্থানীয় একটি দুষ্ট চক্রের ষড়যন্ত্রের শিকার। এই দুষ্ট মানুষগুলো তাদের দুর্নীতি ঢাকার জন্য আমাকে ঘায়েল করতে ধর্মকে বেছে নিয়েছে।”
এই কাজে নিজের শিক্ষার্থীদেরকে ব্যবহার করায় ঘৃণা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমি আমার শিক্ষার্থীদের ক্ষমা করেছি, কিন্তু এর পেছনে যারা আছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব প্রশাসনের।”
ক্লাসরুমে শিক্ষকের কাছে ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে ছাত্রদের কিছু প্রশ্ন ও এর প্রেক্ষিতে দেয়া উত্তরের একটি গোপন ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে আন্দোলন করে কিছু শিক্ষার্থী।
এর প্রেক্ষিতে স্কুলের একজন সহকারী হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে মামলা করলে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
হৃদয় মণ্ডল গ্রেপ্তারের পর স্কুলটির প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, দশম শ্রেণির ক্লাসে ছাত্র-শিক্ষকের প্রশ্ন উত্তরের ঘটনা ঘটে ২০ মার্চ। কিন্তু তার পরদিন ১০/১২ জন ছাত্র এসে তাঁর কাছে বিজ্ঞান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ করে।
ছাত্রদের অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি ওই শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার পাশাপাশি সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেন। তিনি বলেন, এরপরও ২২ মার্চ ওই শিক্ষকের বাড়িতে আক্রমণ করা হয়।
ধর্মকে ব্যবহার করে নানা উত্তেজনা ছড়ানোর বিষয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বেনারকে বলেন, “উগ্র সাম্প্রদায়িক একটি চক্র সবসময় ধর্মকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে।”
এই চক্রের বিরুদ্ধে সরকার ও প্রশাসনকে সব সময় তৎপর থাকার দাবি জানিয়ে কুদ্দুস বলেন, সব ধরনের সাম্প্রদায়িক উস্কানিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধান বিরোধী বিবেচনা করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।