যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মুসলিম শিক্ষক দিয়ে অমুসলিমদের ধর্মশিক্ষা দেবার প্রসঙ্গ
2021.05.12
ঢাকা
বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অমুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষক না থাকার বিষয়টি বিশেষভাবে উঠে এসেছে বুধবার প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে।
ওয়াশিংটন ডিসিতে বুধবার সকালে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিংকেন।
বাংলাদেশে সরকার অনুমোদিত স্কুলগুলোতে তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ ধর্মের ওপর পাঠ গ্রহণ করলেও “তাদের শিক্ষকরা সবক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ধর্মের অনুসারী নন।”
এতে বলা হয়, “ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অব্যাহতভাবে বলে আসছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত সংখ্যক সংখ্যালঘু ধর্মীয় শিক্ষক না থাকায় তাঁদের সন্তানরা ধর্মের ক্লাসে যুক্ত হতে পারছে না।”
প্রতিবেদনের এই বক্তব্যকে যথার্থ বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।
বাংলাদেশে অমুসলিম শিক্ষার্থীদের মুসলমান শিক্ষকদের কাছ থেকে ধর্ম বিষয়ে পাঠ গ্রহণ করতে “একরকম বাধ্য করা হচ্ছে,” জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম বিষয়ে অনভিজ্ঞ এবং অশ্রদ্ধাপরায়ণ ওই শিক্ষকরা প্রায়ই কোমলমতি অমুসলিম শিশু ও কিশোরদের মানসিকভাবে হেনস্তা করেন।”
স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান আমলেও স্কুল কলেজে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল না জানিয়ে রানা দাশগুপ্ত বলেন, বাংলাদেশ সরকার ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করলও “অমুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়নি।”
বারবার ভিন্নধর্মাবলম্বীদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানালেও সরকার কর্ণপাত করছে না বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “এই বাস্তবতায় আমরা সরকারকে অনুরোধ করেছি, যতদিন অমুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে না পারবেন ততদিন আমাদের সন্তানদের জন্য বিদ্যালয়ে ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক না করে ঐচ্ছিক করেন।”
“অনেক শিক্ষক ভিন্নধর্মের শিশুদের প্রতি অসংবেদনশীল আচরণ করেন এবং তাদের ধর্মকে হেয় করেন। এটা শিশুদের প্রতি এটি অন্যায়,” বলেন রানা দাশগুপ্ত।
“সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীরা শুধু ধর্মীয় ক্লাসে মুসলমান শিক্ষকদের দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছে, এমন নয়। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি সংখ্যালঘু শিশুরা সাধারণ শিক্ষা ক্লাসেও তাদের শিক্ষক ও সহপাঠীদের বুলিংয়ের শিকার হয়,” বেনারকে বলেন লেখক ও মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ মাহমুদ।
তাঁর মতে, এই সংকট কাটিয়ে উঠতে, “শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।”
এদিকে “ধর্মশিক্ষার নামে শিশুদের মনোজগতে ধর্মীয় বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়া বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতার অন্যতম বাধা,” বলে মনে করেন কথা সাহিত্যিক স্বকৃত নোমান।
তিনি বেনারকে বলেন, “প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো শিশুকেই ধর্ম শিখতে বাধ্য করা উচিত নয়। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নেবে কে কোন ধর্মের ওপর পড়াশোনা করবে বা চর্চা করবে।”
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বেনারের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনীকে একাধিকবার ফোন করে এবং তাঁর ফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ধর্মান্তরিতদের নিগ্রহ, সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ ও ভূমিদখল
বাংলাদেশে ইসলাম অথবা হিন্দুধর্ম থেকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিতরা সবসময় সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশে ধর্ম পরিবর্তনের সাংবিধানিক অধিকার থাকলেও খ্রিস্টান কল্যাণ ট্রাস্ট এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থার বরাত দিয়ে এতে বলা হয়, ধর্মান্তরিতদের হেনস্থা, শারীরিকভাবে আক্রমণ, সাম্প্রদায়িক হুমকি এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার খবর অবিরত পাওয়া যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক আক্রমণের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং তার বিচার না হওয়ার বিষয়গুলো প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
লালমনিরহাটে কথিত কোরান অবমাননার অভিযোগে একজনকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা, ধর্ম অবমাননার দায়ে বউল শিল্পী শরিয়ত সরকারকে গ্রেপ্তার, বাউল রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে মামলা, গাজীপুরে এক মাজারে একজন সুফি অনুসারীকে হত্যা এবং আহমাদিয়া মুসলমান সম্প্রদায়ের এক শিশুর লাশ কবর থেকে তুলে ফেলে দেওয়ার মতো কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।
দেশে ব্লাসফেমি আইন না থাকলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং দণ্ডবিধির কিছু ধারা ধর্মীয় অবমাননার বিরুদ্ধে প্রয়োগ হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অনেকেই একই সাথে জাতিগত সংখ্যালঘু উল্লেখ করে তাঁদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, “সংখ্যালঘুদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ ও জমি দখল রোধে সরকার প্রায়ই নিষ্ক্রিয় থাকে।”
এতে বলা হয়, মৌলভীবাজার ও মধুপুর বনাঞ্চলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের জমির ওপর সরকারি নির্মাণ প্রকল্প অব্যাহত রাখা হয়েছে।
সংখ্যালঘু সংগঠনগুলোর মতে, নতুন রাস্তা বা শিল্পস্থাপনার নিকটবর্তী অঞ্চলগুলোতে জমির দাম বেড়ে যাওয়ায় এধরনের বিরোধ বেশি হচ্ছে।
স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা আর্থিক লাভের জন্য সম্পত্তি অধিগ্রহণ এবং দখলদারদের রক্ষা করেন বলেও অভিযোগ করা হয় প্রতিবেদনে।
তবে বাংলাদেশে গ্রাম্য সালিশ এবং বিচারবহির্ভূত ফতোয়ার মাধ্যমে নিগ্রহের ঘটনা কমেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এছাড়া সম্ভাব্য হামলা থেকে রক্ষার জন্য সরকার সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্থাপনা, উৎসব ও অনুষ্ঠানে সবসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মোতায়েন রাখে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।