সাম্প্রদায়িক হামলার শঙ্কার মধ্যে পূজার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা
2023.10.13
ঢাকা
সাম্প্রদায়িক হামলার আশঙ্কা নিয়েই এ বছর বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাঁদের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিগত কয়েক বছর ধরে পূজা মণ্ডপে বিচ্ছিন্নভাবে হামলার ঘটনা ঘটছে। আগামী বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের কারণে এবার বেশি সহিংসতার আশঙ্কা করছে সংখ্যালঘু সংগঠনগুলো।
শুক্রবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের আশঙ্কার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ। পৃথক কর্মসূচি থেকে একই আশঙ্কার কথা জানিয়েছে আরও তিনটি হিন্দু সংখ্যালঘু সংগঠন।
ঢাকায় যখন পূজার সময় হামলার আশঙ্কার কথা বলছিল সংগঠনগুলো, সে সময় কুমিল্লায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
সংগঠনটির নেতাদের দাবি, সেখানে ছাত্রলীগের হামলায় এক নারীসহ কমপক্ষে তিন জন আহত হয়েছেন।
এদিকে গত বুধবার নির্বাচন কমিশনে (ইসি) একটি স্মারকলিপি দিয়ে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ দাবি করেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাকে যেন ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করা হয়।
এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, “বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে কমিশন।”
আশঙ্কার মধ্যে পূজার প্রস্তুতি
আগামী ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গাপূজার উৎসব অনুষ্ঠিত হবে।
এ বছর সারা দেশে ৩২ হাজার ৪০৮টি মণ্ডপে পূজা হবে, যার মধ্যে ২৪৪টি রাজধানীতে বলে ঢাকার শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে আয়োজিত শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে জানায় বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ।
“এ বছর এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০টি পূজা মণ্ডপে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে,” জানিয়ে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলেন, প্রতিমা ভাঙার সংবাদের মধ্য দিয়ে মানুষ জানতে পারে শারদীয় উৎসব আসন্ন, “এটা বাংলাদেশের বাস্তবতা।”
“সারা বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর, জায়গা-জমি ও মন্দির-শ্মশান জবর-দখল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। পূজাকে সামনে রেখে হামলা বেড়ে যায়,” বলেন তিনি।
গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৩৫টি সংখ্যালঘু নির্যাতন ও মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এসব ঘটনার একটির বিচার হয়েছে—এমন নজির নেই।”
এই ৩৫টি হামলার ঘটনার মধ্যে হিন্দু মন্দির ও সম্পত্তিতে হামলার সময় ছয় জন নিহত হয়েছেন বলেও জানান তিনি।
লিখিত বক্তব্যে কয়েকটি দাবি তুলে ধরে পূজা উদযাপন কমিটি।
এসব দাবির মধ্যে রয়েছে, সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতার অবসানে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সব সম্প্রদায়ের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ; জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন ও সংখ্যালঘু আইন সরকারের চলতি মেয়াদে বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়।
এছাড়া অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করে প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া; জাতিগত সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব আইন-কানুন বাতিলকরণ; হিন্দু ফাউন্ডেশন গঠন এবং হিন্দু ফাউন্ডেশন গঠিত না হওয়া পর্যন্ত ট্রাস্ট পরিচালনার ব্যয় নির্বাহে রাজস্ব বাজেটে হিন্দুদের সংখ্যানুপাতে অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিতকরণ এবং মঠ-মন্দির নির্মাণ ও উন্নয়নে প্রতি বছর বাজেটে বরাদ্দ রাখা ও দুর্গা পূজায় তিন দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করার দাবি জানানো হয়।
দুর্গোৎসব, লক্ষ্মীপূজা ও কালীপূজা চলাকালে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি না দিতে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুরোধ জানানো হয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে।
কুমিল্লায় সংখ্যালঘুদের মিছিলে ক্ষমতাসীনদের হামলা
শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে কুমিল্লা নগরীতে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বিক্ষোভ মিছিলে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে মিছিলে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসকে নিয়ে মুন্সীগঞ্জের মেয়র ফয়সাল বিপ্লব ‘সাম্প্রদায়িক গালিগালাজ’ করায় এবং কুমিল্লা-৬ আসনের ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার দুর্গা পূজা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করাসহ কয়েকটি ঘটনার প্রতিবাদে কুমিল্লায় সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেছিল ঐক্য পরিষদ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি অধ্যক্ষ তাপস বকসী সাংবাদিকদের বলেন, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ শেষ করে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কান্দিরপাড় এলাকার উদ্দেশে রওনা দিলে প্রথমে পুলিশ বাধা দেয় এবং পরে যুবলীগ ও ছাত্রলীগকর্মীরা মিছিল নিয়ে এসে হামলা করে।
এ ঘটনায় এক নারীসহ তিন জন গুরুতর আহত হয়েছেন বলে জানান তিনি।
কুমিল্লা মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক আবদুল্লা আল মাহমুদ সহিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্যের প্রতিবাদে’ শান্তি মিছিল দেখে ঐক্য পরিষদের নেতা-কর্মীরা সংসদ সদস্য বাহারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অশালীন স্লোগান দিতে থাকে এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরে শান্তি মিছিল থেকে কিছু কর্মী ঐক্য পরিষদের কর্মীদের ধাওয়া করে।
এই ঘটনার খবর পাওয়ার পরে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ থানার সামনে অবস্থান নেন পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা-কর্মীরা।
পুলিশের প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে হামলায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে তারা রাস্তা ছেড়ে দেন।
এ সময় ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, “সংখ্যালঘুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা চালাচ্ছে, হুমকি দিচ্ছে এবং অনেকের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়ার একটি সক্রিয় পাঁয়তারা চলছে।”
তিনি বলেন, “৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যদি তাদের শাস্তির আওতায় আনা না হয় তাহলে আমরা ঘরে থাকব না। পুলিশের অনুরোধ ও মানবিকতার দোহাই মানব না।”
নির্বাচন কাছাকাছি হওয়ায় শঙ্কা বেশি
সংখ্যালঘুদের আশঙ্কার বিষয়ে জানতে চাইলে, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বেনারকে বলেন, “আশঙ্কা কিন্তু আশঙ্কাই। এটি সত্য না-ও হতে পারে। তবে অতীত অভিজ্ঞতা এবং সার্বিক পারিপার্শ্বিকতার কারণেই এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে এবং তা অমূলক নয়।”
তিনি বলেন, “অতীতে প্রায় প্রতি বছরই দেখা গেছে, পূজার সময় এবং নির্বাচনের সময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এ বছর পূজা এমন এক সময় হচ্ছে, যখন জাতীয় নির্বাচনও খুব কাছাকাছি।
“সুতরাং একটি মহলের জন্য এটা একটা বিশেষ উপলক্ষ হয়ে উঠতে পারে। তাই সরকারকে যে কোনো বছরের তুলনায় অধিকতর সতর্ক থাকতে হবে,” বলেন তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “পূজার নিরাপত্তা নিয়ে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অত্যন্ত সতর্ক। পূজা মণ্ডপগুলোতে নিরাপত্তা ব্যাপকভাবে জোরদার করা হবে।”
পূজায় যাতে কোনো সহিংসতা বা হামলার ঘটনা না ঘটে সে জন্য পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনী সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “অতীতের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোনো না কোনো গুজবের সূত্র ধরেই সহিংসতার উৎপত্তি ঘটে বেশিরভাগ সময়। সে জন্য এ বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে পুলিশ।”