বাংলাদেশে একই দিনে তিন ধর্মের তিন উৎসব: সাম্প্রদায়িকতা কিছু ‘স্বার্থান্বেষী মহলের কাজ’
2021.10.20
ঢাকা
সপ্তাহজুড়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার প্রেক্ষাপটে বুধবার একইদিন কাকতালীয়ভাবে এসে হাজির হয় ঈদে মিলাদুন্নবী, লক্ষ্মীপূজা এবং প্রবারণা পূর্ণিমা, যেগুলো বাংলাদেশে পালন করা হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে।
এই প্রেক্ষাপটে তিন ধর্মের নেতারাই যার যার ধর্ম পালনের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
“আজকে একটি অভাবনীয় দিন। আমাদের প্রধান তিন ধর্মের উৎসব পালিত হয়ে গেলো,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশ জমিয়াতুল ওলামার চেয়ারম্যান মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ।
তিনি বলেন, “আজ ইসলাম ধর্মের মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর জন্ম ও মৃত্যু দিবস। এই ঈদে মিলাদুন্নবী আমাদের জন্য বিরাট উৎসব। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাঁদের লক্ষ্মী পূজা পালন করলেন এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তাঁদের প্রবারণা পূর্ণিমা পালন করলেন।”
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন বলেন, সবাই নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসব পালন করলেন। কোথাও কোনো প্রকার সংঘাত, সংঘর্ষ হয়নি। আমরা সবাই সবাইকে সম্মান করলাম—এটি আমরা শত শত বছর ধরে করে আসছি, এটিই আমাদের শক্তি।”
তাঁর মতে, “সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা মণ্ডপ ও বাড়িঘরে যে হামলা হয়েছে সেটি প্রকৃতপক্ষে কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কাজ, দেশের কোনো সাধারণ মানুষ এ ধরনের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত নয়।”
কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বুধবার রাতে বেনারকে জানান, “আজকের অনুষ্ঠানকে মূলত আশ্বিনী পূর্ণিমা বলা হয়। এই দিনে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আষাঢ় মাসে শুরু হওয়া তিন মাসের সংযম শেষ করেন। অনুষ্ঠানের শেষ হিসাবে সন্ধ্যায় ফানুস ওড়ানো হয়।”
“আজকে আমরা শান্তিতে এই অনুষ্ঠান পালন করেছি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছাড়াও এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি থেকে শুরু করে আমন্ত্রিত অতিথিদের প্রায় সবাই ছিলেন মুসলমান,” বলেন তিনি।
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, “আমাদের দেশে কিছু মানুষ কিছু কারণে, কিছু সমীকরণের কারণে অন্যদিকে চলে গেছে। তাদের কাছে শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নয়, কোনো মানুষই নিরাপদ নয়। সুতরাং, তাদের কাজের জন্য দেশের সাধারণ মানুষকে দোষারোপ করা ঠিক হবে না।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড রিলিজিওন অ্যান্ড কালচার বিভাগের অধ্যাপক ফাজরিন হুদা বুধবার বেনারকে বলেন, বুধবার ছিল একটি বিশেষ দিন। এই দিনে তিন ধর্মের তিনটি অনুষ্ঠান হয়ে গেলো।
“এটি সাধারণত দেখা যায় না। কয়েক বছর আগে ২৫ ডিসেম্বর বড়ো দিন ও ঈদে মিলাদুন্নবী একসাথে পালিত হয়,” বলেন তিনি।
তাঁর মতে, “বাংলাদেশে সম্প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে আক্রমণ হয়েছে, সেটি বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশকে বিচার করা যাবে না। আমাদের দেশে সকল ধর্মের সহবস্থানের সংস্কৃতির গোড়া অনেক গভীরে। আমরা ঐতিহাসিকভাবে সুলতানী আমল, মুঘল আমল থেকে শুরু করে সবসময় একসাথে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করে আসছি।”
“এদেশের মানুষ সকলে সকল উৎসবে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। এটিই ধর্মীয় সহবস্থান,” বলেন ফাজরিন হুদা।
হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ বুধবার বেনারকে বলেন, “আজকে দেশের প্রধান তিন ধর্মের তিনটি উৎসবের দিন। এই উৎসবকে মাথায় রেখে পোড়া ঘরের মধ্যেই আমরা আবার নতুন করে বাঁচতে চাই।”
“হয়তো ঈশ্বর আমাদের তিন ধর্মের মানুষকে একসাথে করার জন্যই একইদিনে তিন ধর্মের উৎসব এনে দিয়েছেন। তিনি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন আমরা তিন ধর্মের মানুষ হয়েও আমরা একটি জাতি,” বলেন কাজল।
হিন্দু শিক্ষিকা আটক
ঢাকার একটি পুরানো হত্যাকাণ্ডের ভিডিওকে নোয়াখালীর সংখ্যালঘু হত্যার দৃশ্য দাবি করে ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর কারণে ঢাকার বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও আবৃত্তিশিল্পী রুমা সরকারকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
বিষয়টি নিশ্চিত করে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক এবং সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আ ন ম ইমরান খান বুধবার বিকেলে বেনারকে বলেন, “সকালে বেইলি রোডের নিজ বাসা থেকে তাঁকে আটক করা হয়।”
“ঢাকার পল্লবীতে শাহীন উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ভিডিওকে নোয়াখালীর চৌমুহনীর যতন কুমার সাহা হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দাবি করে ফেসবুক লাইভে উসকানিমূলক তথ্য ছড়িয়েছেন তিনি। যে কারণে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে কুর্মিটোলায় র্যাব সদর দপ্তরে আনা হয়েছে,” বলেন তিনি।
রুমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করা হবে কিনা জানতে চাইলে বিকেল পৌনে পাঁচটায় এএসপি ইমরান বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
এর আগে দুপুরে সংবাদ সম্মেলন ডেকে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক এবং নৌবাহিনীর কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ফেসবুক-ইউটিউব ব্যবহার করে উসকানিমূলক অপপ্রচার চালিয়ে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করায় ইতিমধ্যে ২২ জনকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
‘যতন সাহা হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে ফেসবুকে ভাইরাল ভিডিওটি ‘মিথ্যা ও গুজব’ দাবি করে মঙ্গলবার রাতেই পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ১৫ অক্টোবরের যতন হত্যাকাণ্ডের ভিডিও বলে যেটি প্রচার করা হচ্ছে সেটি গত ১৬ মে পল্লবীতে সন্তানের সামনে শাহীন উদ্দিন নামের এক ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ভিডিও।
কুমিল্লায় পূজামণ্ডপ থেকে কোরআন শরীফ উদ্ধারের ঘটনায় ১৩ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া নৈরাজ্যের প্রেক্ষিতে সোমবার রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী” অযাচাইকৃত সংবাদ না ছড়ানোর অনুরোধ জানায় পুলিশ সদর দপ্তর। পরবর্তীতে মঙ্গল ও বুধবার পাঠানো বিবৃতিতেও বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেছে তারা।
মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বেনারকে বলেন, “রুমা সরকার নিজে ওই ভুয়া ভিডিওটি প্রচার বা সেটি শেয়ার করেননি। সেটি দেখে কান্নারত অবস্থায় ফেসবুকে লাইভে নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে তাঁকে গুজবের প্রচারক বলার সুযোগ নেই। তিনিও অপপ্রচারের ফাঁদে ফেসে গেছেন।”
তবে সামাজিক মাধ্যমে এমন স্পর্শকাতর তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে সবারই আরো সতর্ক হওয়া উচিত বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।
রুমা মঙ্গলবার দুপুর পৌনে তিনটার দিকে শুরু করা ফেসবুক লাইভে যতন হত্যার ভিডিও দেখার কথা জানিয়ে বলেছিলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষেরা মাঠে না নামলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এই দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে।
রুমার সাত বছর বয়সী যমজ দুই ছেলে মায়ের অপেক্ষায় রয়েছে জানিয়ে তাঁর সহশিল্পী পলি পারভীন বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বেনারকে জানান, রুমার ছাড়া পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা না দেখে তাঁর দুই সন্তানকে নিজের বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
সারাদেশে আহত অর্ধশত পুলিশ
সম্প্রতি কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত অপ্রীতিকর ঘটনা সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে পুলিশ সদর দপ্তর বলেছে, এ সকল ঘটনায় সারাদেশে সাত জন প্রাণ হারান। যার মধ্যে দুই জন হিন্দু সম্প্রদায়ের এবং পাঁচ জন মুসলিম সম্প্রদায়ের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দায়িত্ব পালনকালে ৫০ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়।
পুলিশ জানায়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারের সকল গোয়েন্দা সংস্থা সার্বক্ষণিকভাবে কড়া নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। গুজব বা উসকানিতে বিভ্রান্ত ও উত্তেজিত না হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নিকটস্থ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করার অনুরোধও জানিয়েছ তারা।