সাম্প্রদায়িক হামলা: বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ
2021.10.28
ঢাকা
দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে কোরান রাখা হয়েছে—এমন অপবাদের রেশ ধরে দেশের ছয় জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজামণ্ডপ, মন্দির ও বাড়িঘরে সাম্প্রতিক আক্রমণের ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা চেয়ে হাইকোর্টে দায়ের করা এক রিট আবেদন শুনানিকালে বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ এই আদেশ দেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন দুই রিটকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
১৩ অক্টোবর শুরু হওয়া এই হামলার সময় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পুলিশ-প্রশাসন ‘নিষ্ক্রয়’ ছিল এমন অভিযোগ উত্থাপন করে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা চেয়ে ২১ অক্টোবর এই রিট দায়ের করেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুই আইনজীবী অনুপ কুমার সাহা ও মিন্টু চন্দ্র দাস।
আদালতের এই নির্দেশে খুশি হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ।
রিট আবেদনকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “আদালত তাঁর আদেশে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রতিক আক্রমণের ঘটনাগুলো বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে হাইকোর্টে পাঠাতে বলেছেন। এই বিচার বিভাগীয় তদন্ত আগামী ষাট দিনের মধ্যে হাইকোর্টে পাঠাতে হবে। এবং আদালত সেটি আলোচনা করে চূড়ান্ত আদেশ দেবেন।”
আদালতের আদেশ সরাসরি সংশ্লিষ্ট জেলার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অথবা মেট্রোপলিটন সিটির ক্ষেত্রে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চলে যাবে। তাঁরা বিষয়টি তদন্ত করে হাইকোর্টের কাছে প্রতিবেদন পাঠানোর পর হাইকোর্ট সেটি নিয়ে আলোচনা করে চূড়ান্ত আদেশ দেবে বলে জানান ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময়।
তিনি বলেন, “আমরা রিট আবেদনে বলেছি, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেণী, রংপুর ও চট্টগ্রামে উগ্রবাদী ধর্মান্ধরা সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজামণ্ডপ ভাঙচুর করেছে ও বাড়িঘরে আক্রমণ চালিয়েছে, বসতবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই আক্রমণের সময় বার বার পুলিশ-প্রশাসনকে জানান হলেও তাঁদের রক্ষার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল ‘ব্যর্থ ও ‘নিষ্ক্রিয়’।”
“আমরা মনে করি রাষ্ট্র সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সেকারণেই হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষে দুই আইনজীবী এই রিট আবেদন করেছেন, আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন,” বলেন তিনি।
আদেশে আদালত হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের এসব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের নিরাপত্তা দিতে স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা সম্পর্কে জানতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে বলেও জানান তিনি।
আইনানুযায়ী, সরকারকে এই আদেশের লিখিত জবাব দিতে হবে।
রিট শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ.এম. আমিন উদ্দিন।
“আমরা আদেশটি পর্যালোচনা করে দেখবো এবং এরপর জবাব দেবো,” জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “তবে আদালতে জানানো হয়েছে যে, হিন্দু সম্প্রদায়কে রক্ষার জন্য রাষ্ট্র নীরব ছিল না।”
আদালতের এই আদেশ সম্পর্কে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ধর্মান্ধদের আক্রমণ যে অন্যায় তা প্রতিষ্ঠিত হলো। আমরা বলতে পারি হাইকোর্ট আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন।”
“বিচার বিভাগীয় তদন্তে যে সবসময় প্রকৃত ঘটনা আসে তা নয়। কারণ এই তদন্তগুলো করেন বিভিন্ন ব্যক্তি। তবে, বিচার বিভাগীয় তদন্ত বহুলাশেং সত্য উদঘাটনে সহায়তা করে। সেকারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যাপারে একটি আস্থা রয়েছে,” বলেন তিনি।
মোট ৮১ মামলা, রংপুরে রিমান্ডে ৬০
চট্টগ্রাম বিভাগের ১০ জেলা এবং রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার দায়ে মোট ৮১ মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
রংপুরের পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ায় হামলার ঘটনা আরও নতুন করে দশ আসামির দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। বৃহস্পতিবার দুপুরে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক ফজলে এলাহি খান এ আদেশ দেন। এ নিয়ে এ ঘটনায় ৬০ আসামিকে রিমান্ডে নিলো পুলিশ।
পীরগঞ্জ আমলি আদালতের সাধারণ নিবন্ধক শহীদুর রহমান স্থানীয় সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, মণ্ডপ ভাঙচুর, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন উস্কানিমূলক ও সাম্প্রদায়িক পোস্ট দেয়াসহ বিভিন্ন অপরাধের দায়ে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ৭৭ মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান বিভাগীয় ডিআইজি মো. জাকির হোসেন খান।
এই মামলাগুলোর বিপরীতে কমপক্ষে ৫৬৭ জনকে আটক করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
রংপুর জেলার পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পীরগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার দায়ে মোট চারটি মামলা হয়েছে এবং এই মামলায় ৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সরকারকে বিব্রত করতে সাজানো গল্প: ড. মোমেন
সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি এবং কোনো মন্দিরে অগ্নিসংযোগ হয়নি বা কোনো মন্দির ধ্বংস করা হয়নি বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। তিনি বলেছেন, সরকারকে বিব্রত করতে কিছু উৎসাহী গণমাধ্যম এবং ব্যক্তি সংখ্যালঘু ধর্ষণ ও মৃত্যুর সাজানো গল্প ছড়াচ্ছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি বলেন, গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার একটি মণ্ডপে ‘কোরআন অবমাননা’র খবর ছড়ানোর পর চাঁদপুর, রংপুর, ফেনী, নোয়াখালীসহ দেশের বেশকিছু এলাকায় সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় জড়িতদের বেশিরভাগকেই গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
কুমিল্লায় মণ্ডপে কোরআন রাখা ইকবাল হোসেনের বিষয়টি টেনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “পূজামণ্ডপে কোনো উপাসক বা আয়োজক না থাকার সুযোগ নিয়ে একজন মাদকাসক্ত একটি মূর্তির পায়ের কাছে পবিত্র কোরআন শরিফ রেখে যায়, যা আরেক ব্যক্তি ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। এটি ক্ষোভের জন্ম দেয়, যার পরিণতিতে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।”