শেখ হাসিনার বক্তৃতার প্রতিবাদে ভাঙচুর ও আগুনের শিকার বঙ্গবন্ধুর বাড়ি
2025.02.05
ঢাকা

রাজধানীর ধানমন্ডিতে বুধবার রাতে ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর।
ঘটনার সূত্রপাত হয় গত আগস্টে ছাত্র ও জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফেসবুক লাইভে ভাষণ দেবার ঘোষণাকে কেন্দ্র করে।
আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুধবার শেখ হাসিনার লাইভ ভাষণের ঘোষণা দেয়া হয়। ওই ঘোষণার প্রতিবাদে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ওই বাড়ি অভিমুখে ‘২৪-এর বিপ্লবী ছাত্র জনতা’র ব্যানারে ‘বুলডোজার মিছিল’ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়।
বুধবার বিকেলে ধানমন্ডির ওই বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেবার আহ্বান জানিয়ে ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দেন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য শরিফ ওসমান হাদি।
সন্ধ্যার পর থেকেই ওই বাড়ির সামনে বিক্ষোভ চলতে থাকে, পাশাপাশি শুরু হয় ভাঙচুর।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা বেনার প্রতিনিধিরা এ সময় কয়েক শ মানুষকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর করতে দেখেছেন। একই সময় বাড়িটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে বাইরে স্লোগান দিচ্ছিলেন কয়েক শ মানুষ।
প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর গত আগস্টেও বাড়িটি ভাঙচুরের শিকার হয়েছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬১ সাল থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সপরিবারে এই বাড়িতেই থাকতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই বাড়িতেই তিনি সপরিবারে হত্যার শিকার হন। তখন দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান শুধু তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৯৯৪ সালে বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটি আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
বুধবার রাত সোয়া আটটায় বাড়িটিতে বিক্ষোভকারীরা আগুন ধরিয়ে দেন। এর ঘণ্টাখানেক পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর একটি দল এলেও বিক্ষোভকারীদের বাধার মুখে ১০ মিনিটের মধ্যে চলে যায়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা বেনার প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পেছনের ভবনেও আগুন জ্বলতে দেখেছেন।

কেউ এসেছে ভাঙতে, কেউ দেখতে
রাত সাড়ে নটার দিকে পুড়তে থাকা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে রড হাতে দেখা মেলে নিউ মডেল ডিগ্রী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. তরিকুল ইসলামের।
তিনি বেনারকে বলেন বলেন, “শেখ হাসিনা অনলাইনে বক্তৃতা রাখার প্রতিবাদে তাঁর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে আমরা এই বাড়ি ভাংচুর করতে এসেছি।”
সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াসহ আরো কয়েকজন ইনফ্লুয়েন্সারের ফেসবুক পোস্ট দেখে ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙতে আসার কথা জানান তরিকুল।
গাজীপুরের কাপাসিয়া এলাকার ব্যবসায়ী মো সবুজ (৫৪) আরেকজনের সাথে মোটরসাইকেলে করে ধানমন্ডি এসেছেন। তিনি বেনারকে বলেন, “গত ১৫ বছর ধরে যে অপশাসন ও দুর্নীতি হয়েছে তার প্রতীক ওই বাড়িটি আমরা গুড়িয়ে দেয়া দেখতে এসেছি।”
রাত সাড়ে দশটার পর পুড়তে থাকা ওই বাড়িটি দেখার জন্য জড়ো হন কয়েক হাজার মানুষ।
বাড্ডা থেকে বন্ধুকে নিয়ে এসেছেন খান বাহাদুর ইমরান। রাত ১১.১০ মিনিটে বাসায় ফেরার পথে একটি ইট নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, “এই ইট ড্রয়িংরুম বাঁধিয়ে রাখব। আমার পরবর্তী প্রজন্ম যাতে এই স্বৈরাচারের সম্পর্কে জানতে পারে।”

শেখ হাসিনার বাড়িতেও আগুন
এদিকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়ির পর রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার ৫ নম্বর সড়কে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনেও আগুন দিয়েছে ছাত্র-জনতা।
বুধবার রাত পৌনে ১১টার দিকে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা এ আগুন দেয়।
ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের বিষয়ে কথা বলতে চাননি পুলিশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা।
তবে রমনা জোনের এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বেনারকে বলেন, সন্ধ্যা ৭.৫৫ মিনিট উত্তেজিত ছাত্র-জনতা ধানমন্ডির প্রধান ফটকে লাঠিসোটা নিয়ে প্রবেশ করে। এ সময় পুলিশ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তারা পুলিশের দিকে তেড়ে আসে। পরে পুলিশ সরে রাস্তা থেকে সরে যায়।
সুধা সদনের আগুনের বিষয়ে ধানমন্ডি ৫ নম্বর সোসাইটির সিকিউরিটি ইনচার্জ মো. জামাল হোসেন বেনারকে বলেন, রাত ১০ টার দিকে খবর পেলাম লোকজন আসতেছে, সুধা সদনে আগুন দেবে। আমরা এখানে পৌঁছাতেই দেখি কিছু লোকজন বাড়িতে প্রবেশ করে আগুন দিয়ে দিয়েছে।
সুধা সদনে আগুনের কারণে এই এলাকার ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ রাখা হয়েছে। এর ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন আশেপাশের বাড়িগুলোর বাসিন্দারা।

লাইভে হাসিনা: নিশ্চয় আমার কিছু কাজ বাকি আছে
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটি যখন আগুনে পুড়ছিল তখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে লাইভে এসে ভাষণ শুরু করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে তিনি কোন জায়গা থেকে ভাষণ দিচ্ছেন তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি।
প্রায় আধাঘণ্টার ভাষণে তাঁর শাসনামলের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরার পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের তীব্র সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা।
“আল্লাহ যখন বাঁচিয়ে রেখেছে, নিশ্চয় আমার কিছু কাজ বাকি আছে। সেটুকু করার জন্যই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে,” উল্লেখ করে তিনি অভিযোগ করেন, মুহাম্মদ ইউনূসের পরিকল্পনা ছিল তাঁকে ও তাঁর বোন শেখ রেহানাকে “হত্যা করা।”
অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ইউনূসের “ক্ষমতা দখল সম্পূর্ণ অবৈধ, অসাংবিধানিক,” মন্তব্য করে হাসিনা বলেন, ইউনূস “অস্ত্র ও অর্থের জোরে মানুষ খুন করে মানুষের লাশের ওপর পা দিয়ে” ক্ষমতায় এসেছেন।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তারা একটা দালান ভাঙতে পারে, কিন্তু ইতিহাসকে তারা ধ্বংস করতে পারে না। ইতিহাস কিন্তু তার প্রতিশোধ নেয়, এটাও তাদের মনে রাখতে হবে।”
তিনি বলেন, “এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে যেন বাংলাদেশ মুক্তি পায়। এই দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে যেন বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি পায়, বাংলাদেশের মানুষ যেন জীবনের নিরাপত্তা পায়, শান্তিতে চলতে পারে, সেটাই আমাদের কামনা, সেটাই আমরা চাই।”
“বাংলাদেশের মানুষকে বলব, আপনরাও এসবের প্রতিবাদ করবেন, প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। বাংলাদেশেকে এভাবে ধ্বংস হতে দেবেন না। আমি আছি আপনাদের পাশে। আমি যত দূরেই থাকি না কেন, আমার মন আপনাদের সাথে আছে, আপনারা আমার মনের ভেতরে আছেন,” বলেন শেখ হাসিনা।