মিয়ানমারের গুলি-মর্টার শেলে হতাহতের ঘটনায় ঢাকার কড়া প্রতিবাদ

আব্দুর রহমান
2024.02.06
তুমব্রু সীমান্ত, বান্দরবান
মিয়ানমারের গুলি-মর্টার শেলে হতাহতের ঘটনায় ঢাকার কড়া প্রতিবাদ প্রাণভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বিজিপি সদস্যদের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এর (বিজিবি) পাহারায় বান্দরবানের ঘুমধুম নেওয়া হচ্ছে। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
[আব্দুর রহমান/বেনারনিউজ]

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের জেরে দেশটির নাগরিকদের অনুপ্রবেশ, গুলি-মর্টার শেল সীমান্তের এপারে এসে পড়া এবং হতাহতের ঘটনায় মঙ্গলবার কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।

একই দিন মিয়ানমারের দিক থেকে আসা গুলিতে চার বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। পাশাপাশি দেশটির সেনা ও বিজিপির আরও শতাধিক সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এ পর্যন্ত তিন দিনে মিয়ানমারের অন্তত ২৬৪ সেনা ও বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

“আজকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। তাঁদের অভ্যন্তরীণ কনফ্লিক্টের কারণে আমাদের দেশে তাঁদের নাগরিকেরা প্রবেশ করছে। একইসঙ্গে তাঁদের ওখান থেকে গোলা-বারুদ এসে আমাদের এখানে পড়া এবং আমাদের মানুষ আহত-নিহত হওয়ার ঘটনাগুলোর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে,” মঙ্গলবার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের যেখানে আমরা ফেরত পাঠানোর জন্য কাজ করছি, সেখানে এই ধরনের ঘটনা অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত ও অগ্রহণযোগ্য—এটা আমরা জানিয়েছি। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত তাঁর সরকারের কাছে আমাদের এই কড়া প্রতিবাদের বার্তাটা পৌঁছে দেবেন বলে জানিয়েছেন।”

মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (মিয়ানমার অনুবিভাগ) মিয়া মো. মাইনুল কবির প্রতিবাদপত্র তুলে দেন অং কিউ মোয়ের হাতে।

বাংলাদেশে প্রাণহানি বা সম্পত্তির জন্য ক্ষতিকারক কর্মকাণ্ড বন্ধে মিয়ানমার সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি পালিয়ে আসা বিজিপি সদস্যদের দ্রুততার সঙ্গে ফেরত নেওয়ার বিষয়টিও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিন সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মিয়ানমার বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান যাতে বাংলাদেশের সীমানায় না ঢোকে, সে ব্যাপারে দেশটিকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী পুলিশ (বিজিপি), সেনা, ইমিগ্রেশন বিভাগ, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার ২৬৪ জন সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, “গতকাল রাত পর্যন্ত ১১৫ জন বিজিপি, মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য সদস্যরা আমাদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। আজ সকালে আরও ১১৪ জন যোগ হয়েছে। ২২৯ জন আশ্রয় নিয়েছিলেন, পরবর্তীতে আজ দুপুরের মধ্যে আরও ৩৫ জন যোগ হয়ে বর্তমানে এই সংখ্যা ২৬৪ জন।”

সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা ধৈর্য ধারণ করে, মানবিক দিক থেকে এবং আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করছি।”

শিগগির তাঁদের প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা হবে বলে এ সময় আশাবাদ ব্যক্ত করেন আশরাফুজ্জামান।

বিজিবি মহাপরিচালক আরও জানান, এদিন সকালে পানিপথে নৌকা নিয়ে নতুন করে ৬৫ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় বিজিবি সদস্যরা তাঁদের প্রতিহত করেন। তাঁরা যেন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারেন সে ব্যাপারে বিজিবি সতর্ক আছে।

তিনি বলেন, “নতুন করে আর কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।” 

ad02c9f3-bc1f-4615-b9d3-d92eee41f31e.jpg
মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের জেরে কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী রহমতের বিল এলাকায় মর্টার শেল পড়ার শব্দে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটে যাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪। [মিনহাজ উদ্দিন/বেনারনিউজ]

মিয়ানমারের থেকে ছোড়া গুলিতে আহত আরো ৪

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির পর মঙ্গলবার সকালে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলিতে কক্সবাজারের উখিয়ার রহমতের বিল এলাকায় চার বাংলাদেশি আহত হয়েছেন।

তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুরউদ্দিন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “সকালে শতাধিক রোহিঙ্গাদের একটি দল বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করে। পেছন দিক থেকে কিছু গুলি চালানো হয়। সেই সঙ্গে মর্টার সেল বিস্ফোরিত হয়।”

স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তাঁদের মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ হন, যাদের একজন রহমতের বিল এলাকার বাসিন্দা আনোয়ারুল ইসলাম।”

বাকিদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি গফুর। তিনি বলেন, “আহতদের কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।”

তিনি আরও জানান, বাংলাদেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে চারটি অস্ত্র উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। 

সীমান্তের গ্রামগুলো জনমানবশূন্য

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের বিরতিহীন লড়াই চলছে। সীমান্তের কাছে গুলিবর্ষণ ও মর্টার শেল বিস্ফোরণ এবং প্রাণহানির পরে বাংলাদেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ঘর-বাড়ি ছেড়ে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে ছুটছেন।

মঙ্গলবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়ন এবং কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ও টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, গুলির শব্দে কেঁপে উঠছে চারপাশ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত রাতেও বেতবুনিয়া সীমান্তের ওপার থেকে কিছুক্ষণ পরপর থেমে থেমে বিকট শব্দ পাওয়া গেছে।

উখিয়ার পালংখালী রহমত বিল এলাকার বাসিন্দা নূর খান বেনারকে বলেন, “সকাল থেকে সীমান্তের ওপারে তুমুল যুদ্ধ চলছে। সকাল ৯টার পরে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে বেশ কিছু লোক অনুপ্রবেশ করেছে। বিজিবি তাদের আটক করে প্রথমে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাখে, বিকেলে বিজিবির হেফাজতে নেয়। সীমান্তের ওপারে আমরা আগুন জ্বলতেও দেখেছি।”

উখিয়া সীমান্তের পুটিবনিয়া লম্বাবিল সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা হাফিজ আলম বেনারকে বলেন, “প্রায় এক সপ্তাহ হলো তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় গুলি, মর্টার শেল ও গ্রেনেড বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। এখন উখিয়া থেকেও শোনা যাচ্ছে। আতঙ্কে মানুষ ঘর-বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে।”

আশ্রয়কেন্দ্র চালু

বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, জলপাইতলী এলাকায় দুই জনের মৃত্যুর পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে দুটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

এদিন সীমান্ত পরিদর্শনে এসে তিনি বলেন, “আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা হয়েছে; ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে সবাইকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাব।”

মোজাহিদ আরও বলেন, “মিয়ানমার থেকে যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের ফেরত পাঠানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।”

বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা বিজিবি, গোয়েন্দা সংস্থা ও জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কাজ করছি। বিজিবি যে ধরনের সহায়তা চাচ্ছে, আমরা তা করছি।”

“রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আমরা সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছি। এই এলাকার মানুষের নিরাপত্তা দিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।