মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা: ৩০০ বাংলাদেশি পরিবার সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা
2022.09.19
বান্দরবান
মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় চলমান অস্থিরতার মধ্যে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম থেকে ৩০০ স্থানীয় পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
সোমবার জেলা প্রশাসকের (ডিসি) নেতৃত্বে জেলা পুলিশের প্রধানসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা ঘুমধুম এলাকা পরিদর্শন করে এই প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। ডিসি ইয়াছমিন পারভীন তিবরিজী এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছেন, “লোকজনকে নিরাপদ স্থানে কোথায় রাখা যায় সে বিষয়টিও আমরা ভাবছি। তবে এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।”
“যেহেতু সীমান্ত এলাকার মানুষ গোলাগুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন, সেখানে আতঙ্ক বিরাজ করছে, সেজন্য তাঁদের কীভাবে নিরাপদ রাখা যায়, সে বিষয়টি আমরা ভাবছি,” যোগ করেন তিবরিজী।
ঘুমধুম সীমান্ত পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বৈঠকে সীমান্তের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে তারা জানান, কোন জায়গাগুলো খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলো শনাক্ত করা হয়েছে এবং সরকার সীমান্তে বসবাসরত নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।
সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতার পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে পুলিশ সুপার তরিকুল সাংবাদিকদের জানান, এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে মিয়ানমার থেকে কেউ বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে না পারে তা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পাশাপাশি পুলিশও খেয়াল রাখছে।
পরিস্থিতি থমথমে
বান্দরবানের ঘুমধুম পশ্চিমকুল গ্রামের নুর আহম্মদ (৬৭) বেনারকে বলেন, “আমার জীবনে এ ধরনের পরিস্থিতি আর দেখিনি। রাতে যখন ঘুমাতে যাই, গোলাগুলির শব্দে চারদিক কেঁপে ওঠে।”
“আমি অসুস্থ মানুষ। ঘুমাতে পারছি না অনেকদিন। এতে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছি। কখন যে এই অবস্থা থেকে রেহাই পাব, ভালো করে ঘুমাতে পারব তা জানি না,” যোগ করেন তিনি।
স্থানীয় যুবক মো. রফিক উদ্দিন জানান, “মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে এক রোহিঙ্গা যুবক মারা যাওয়ার পর এখন এলাকার মানুষ আতঙ্কে ঘুমাতে পারছেন না। চোখে একটু একটু ঘুম এলেই গুলির শব্দ ঘুম ভেঙ্গে যায়।”
মো. ফরিদ আলম নামে অপর বাসিন্দা বেনারকে বলেন, গত কয়েকদিনে উত্তর পাড়া, কোনার পাড়াসহ আশ পাশের এলাকায় অসংখ্য গোলা এসে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে নিজেরা কোথায় যাবেন বা কী করবেন তা ভাবতে পারছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রতিদিন আতঙ্কের মধ্যে কাটছে, কখন যে কী এসে পড়ে। কিন্তু কী করব ঘরবাড়ি ছেড়ে চলেও যেতে পারছি না।”
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে জাহাঙ্গীর আজিজ বেনারকে বলেন, রোববার ভোর রাত থেকে ওপারে গোলাগুলি চলছে। দুপুরের দিকে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়নি। তবে বিকেলের পর আবারও শুরু হয় গোলাগুলি।
দুই মাস ধরে চলা মিয়ানমারের গোলাগুলিতে এলাকার মানুষ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন জানিয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, সীমান্ত এলাকার অন্তত ৩০০ পরিবার নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। ইতিমধ্যে তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
তাঁদের সরিয়ে এনে প্রাথমিকভাবে কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনে রাখার পরিকল্পনা চলছে বলেও জানান তিনি।
জাতিসংঘে চিঠি শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের
মিয়ানমারের মর্টারশেলে হতাহতের প্রতিবাদ জানিয়ে শূন্যরেখার রোহিঙ্গারা মানববন্ধন করেছেন সোমবার।
নিরাপত্তা চেয়ে জাতিসংঘের বরাবরে চিঠি পাঠানো হয়েছে জানিয়ে শূন্যরেখায় অবস্থান করা রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ জানান, “আজও থেমে থেমে সীমান্তে গোলাগুলি হয়েছে। এতে শূন্যরেখার রোহিঙ্গারা ভয়ভীতির মধ্যে পড়েছে।”
মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) দীর্ঘ দিন থেকে শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের সরে যেতে হুমকি দিয়ে আসছে জানিয়ে এই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার পাশাপাশি নিজ দেশে ফিরে যেতে জাতিসংঘের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে চিঠির মাধ্যমে।
বাংলাদেশের প্রতিবাদ, মিয়ানমারের অস্বীকার
শুক্রবার রাতে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টারশেলে একজন নিহত ও কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে তলব করে রোববার ‘কড়া প্রতিবাদ’ জানিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ে এসে নিজেদের ব্যাখ্যা দিয়ে গেলেও সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হননি রাষ্ট্রদূত।
মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বান্দরবান সীমান্তে গোলাবর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করে মিয়ানমার এর দায় ঠেলে দিয়েছে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির দিকে।
দেশটির দাবি, “আরাকান আর্মি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গোলাবারুদ চুরি করে বাংলাদেশে গুলি করছে, যাতে করে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হয় এবং বাংলাদেশ মিয়ানমারকে যাতে অবিশ্বাস করে,” বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
শুক্রবার রাতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু কোনারপাড়া সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া চারটি মর্টার শেল এসে পড়ে। এতে শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক যুবক নিহত হন। আহত হন রোহিঙ্গা শিশুসহ পাঁচজন।
আর কোনো রোহিঙ্গা ঢুকতে দেয়া হবে না
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সংঘাতের জেরে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বারবার মর্টারের শেল পড়ার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এর সুরাহার জন্য শিগগির একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
সোমবার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা মনে করি মিয়ানমার তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার জন্যই নানাভাবে যুদ্ধে জড়িয়েছে। তবে আমরা এখনো সঠিকভাবে জানি না কার সঙ্গে তারা গোলাগুলি করছে কিংবা কাকে তারা প্রতিহত করছে।”
তিনি বলেন, “মিয়ানমার ইস্যুতে আমরা প্রতিবাদ জানাবো। যদি এতে কাজ না হয় তাহলে জাতিসংঘে আমাদের অসুবিধার কথা উত্থাপন করব। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সব সমস্যার সমাধান করতে চাই,” বলেন মন্ত্রী।
এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে আরো রোহিঙ্গা ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা আর কোনো রোহিঙ্গাকে এখানে আর ঢুকতে দেবো না। যে পরিমাণ রোহিঙ্গা এখন আমাদের দেশে রয়েছে তাদের নিয়েই এখন নানা জটিলতায় রয়েছি।”
এদিকে সীমান্ত এলাকায় চলমান উত্তেজনা ও মিয়ানমারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডসহ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে অবগত করতে আসিয়ানভুক্ত সাতটি দেশের কূটনীতিকদের সাথে সোমবার বৈঠক করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে পদ্মায় উপস্থিত আসিয়ান দেশের রাষ্ট্রদূতদের সাথে আলোচনা সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম।
তবে এই বৈঠক সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে গণমাধ্যমকে কিছু জানায়নি মন্ত্রণালয়।
ঢাকা থেকে প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আহম্মদ ফয়েজ।