সন্ত্রাস ও চোরাচালান ঠেকাতে একসঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী
2022.11.29
ঢাকা

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতির অবসান ঘটানো, সীমান্তে সন্ত্রাসীদের অবাধ চলাফেরা ঠেকানো এবং অস্ত্র ও মাদকসহ অবৈধ পণ্যের চোরাচালান বন্ধে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) একমত হয়েছে।
মঙ্গলবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন ডেকে এই তথ্য জানিয়েছেন বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ।
গত ২৩ থেকে ২৭ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে অনুষ্ঠিত মহাপরিচালক পর্যায়ের অষ্টম বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে ওই সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। প্রায় তিন বছর পর দুই বাহিনীর মধ্যে এমন বৈঠক এমন অনুষ্ঠিত হলো।
এসময় মেজর জেনারেল শাকিল জানান, সন্ত্রাসীদের চলাফেরা এবং মাদক ও অস্ত্রের ব্যাপারে দুই দেশ তাৎক্ষণিক তথ্য আদান-প্রদান করবে। প্রয়োজনে যৌথ অপারেশন চালাবে। ফলে সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।
তিনি জানান, সীমান্তের উভয় পাশেই হুমকি বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতার বিরুদ্ধে একসাথে কাজ করবে বিজিবি এবং বিজিপি। সন্ত্রাসীরা যাতে অবাধে সীমান্তে চলাচল করতে না পারে, সে লক্ষ্যে কাজ করবে দুই বাহিনী।
বৈঠকে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ ও মিয়ানমার দলের নেতৃত্বে ছিলেন মিয়ানমারের পুলিশের উপপ্রধান মেজর জেনারেল অং নাইং থু।
দুই পক্ষই সীমান্তের দুই পাশের দুষ্কৃতকারী ও সন্ত্রাসীদের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য বিনিময়ে সম্মত হয়েছে বলে পাঁচ দিনের বৈঠক শেষ হবার আগের দিন, শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় মিয়ানমারের বিজিপির পক্ষ থেকে।
এ বছর সেপ্টেম্বরে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের পরিচালিত সামরিক অভিযানকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে শেল নিক্ষেপ ও বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। এর দুই মাসের মধ্যে উভয় দেশ সীমান্তে যৌথ অপারেশনের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে।
এদিকে চার মাসের টানা যুদ্ধির র পর গত সোমবার আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী সাময়িক অস্ত্র বিরতিতে সম্মত হয়েছে। তবে আরকান থেকে সেনা সরিয়ে নেবার কোনো পরিকল্পনা এখনো মিয়ানমার সরকার করেনি বলে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে জানিয়েছেন দেশটির কর্মকর্তারা।
সাময়িক এই অস্ত্রবিরতি মানবিক কারণে করা হয়েছে বলে রেডিও ফ্রি এশিয়াকে জানান আরাকান আর্মির মুখপাত্র খিন থু খা।
ইতিবাচক ঘটনা
সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিজিবি এবং বিজিপি’র মধ্যে সাম্প্রতিক সমঝোতাগুলোকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক উন্নয়নে ‘ইতিবাচক ঘটনা’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন কূটনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে বড়ো বাধা। তবে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী পারস্পরিক আলোচনা করছে, এটি ভালো উদ্যোগ।”
“বাংলাদেশ ভূখণ্ডে কয়েক দফা মর্টার শেল নিক্ষেপ এবং বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনার পরও বিজিবি এবং মিয়ানমারের বিজিপি সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কাজ করতে সম্মত হয়েছে-এটা ইতিবাচক বিষয়,” বলেন শমসের মবিন।
গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকার সামরিক অভিযান শুরু করার পর ১৬ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মর্টার শেল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসে পড়ে এবং এই ঘটনায় এক রোহিঙ্গা শরণার্থী নিহত হন।
এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানায়। এরপরও বাংলাদেশ ভূখণ্ডে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মর্টার নিক্ষেপ অব্যাহত থাকে। মিয়ানমার হেলিকপ্টার কয়েক দফা বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে।
এর মধ্যে মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠায় সেদেশের সরকার। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আরাকান আর্মি এবং আরসার উপস্থিতি রয়েছে। বাংলাদেশে পড়া মর্টার শেলটি আরাকান আর্মির বলে দাবি করে মিয়ানমার সরকার।
তবে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আরাকান আর্মি এবং আরসার তৎপরতার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে অস্বীকার করে বাংলাদেশ সরকার।
“মিয়ানমার সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তে উস্কানিমূলক কাজ বন্ধ করেছে। চীনের প্রভাবে তারা এই কাজ বন্ধ করে থাকতে পারে,” বলেন শমসের মবিন চৌধুরী।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত কয়েক দফা বলেছেন যে, তারা সীমান্তে এমন কাজ করা থেকে মিয়ানমারকে বিরত থাকতে বলেছেন। আর এটি সবারই জানা যে, মিয়ানমারের ওপর চীনের প্রভাব রয়েছে।”
তাঁর মতে, “মিয়ানমারের সামরিক সরকার আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এমনকি আসিয়ান সভাতেও মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সুতরাং, তারা বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের হাত বাড়িয়েছে। তবে সেটি কতটুকু স্থায়ী হবে সেটি বলা কঠিন।”
“মিয়ানমার অভিযোগ করে যে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আরাকান আর্মি এবং আরসার তৎপরতা রয়েছে। সেকারণে তারা হয়তো এই দুটি সংগঠন নির্মূল করতে বাংলাদেশের সহায়তা কামনা করছে,” যোগ করেন শমসের মবিন চৌধুরী।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর যৌথভাবে কাজ করার সিদ্ধান্তকে “একটি শুভ সূচনা” হিসেবে আখ্যায়িত করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ।
মঙ্গলবার তিনি বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে সন্ত্রাসীরা দুই দেশের মধ্যে অনেকটা অবাধে চলাচল করে। এই সীমান্তে অবৈধ মাদক ও অবৈধ অস্ত্র চোরাচালান এবং মানব পাচার চলে আসছে। এগুলো নিয়ে দুই দেশেরই অস্বস্তি ও শঙ্কা রয়েছে।”
“দুই দেশ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং মানব পাচারের ব্যাপারে তাৎক্ষনিক তথ্য বিনিময় করলে সমস্যা অনেকাংশে কমে আসবে,” বলেন তিনি।