কমিশনের সুপারিশ, সরকারের মেয়াদ কমবে, বাড়বে সংসদ সদস্যের সংখ্যা
2025.01.15
ঢাকা

সরকারের মেয়াদ পাঁচ থেকে চার বছরে নামিয়ে আনা এবং এককক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পরিবর্তে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ প্রবর্তন করার সুপারিশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের নেতৃত্বে নয় সদস্যের সংস্কার কমিশন সংবিধানে গণতন্ত্র রেখে বাকি তিন মূলনীতি-- ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্র বাদ দেওয়ারও সুপারিশ করেছে।
বুধবার সংবিধান সংস্কার কমিশনের এ প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে রয়েছে, সংসদ সদস্যের সংখ্যা বাড়ানো, জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোসহ বিভিন্ন সুপারিশ।
বুধবার একইসঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন এবং পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য দেশের সকল রাজনৈতিক দলের সাথে প্রধান উপদেষ্টা আলোচনা শুরু করবেন বলে ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা
সুপারিশ অনুযায়ী, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি হবে নিম্নকক্ষ এবং সিনেট হবে উচ্চকক্ষ।
নিম্ন কক্ষের সদস্য সংখ্যা হবে ৪০০, যার মধ্যে ৩০০ আসন সাধারণ আর ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। তবে সবাই জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন।
উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা হবে ১০৫। এর ১০০ জন সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন। উচ্চকক্ষে আসন পেতে একটি দলকে মোট প্রদত্ত ভোটের এক শতাংশ পেতে হবে। সিনেটের বাকি পাঁচজন সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ থেকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত হবেন।
দুই কক্ষের মেয়াদ হবে চার বছর। প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদও হবে চার বছর, যা বর্তমানে পাঁচ বছর।
তবে দুই কক্ষের মধ্যে সম্পর্ক কী হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি প্রতিবেদনে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালু করার আগে দেখতে হবে যে, এই দুই কক্ষের মধ্যে কী সম্পর্ক কি হবে। যদি দেখা যায় জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নিম্নকক্ষ থেকে পাশ হওয়া বিল যদি উচ্চকক্ষে আটকে যায় সেটি তখন কেমন হবে?”
ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে বহুত্ববাদ
বিদ্যমান সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতি হলো- গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্র। এগুলোর পরিবর্তে কেবল গণতন্ত্রকে রেখে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও বহুত্ববাদকে মূলনীতি হিসাবে রাখার সুপারিশ করেছে কমিশন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বেনারকে বলেন, “এই অঞ্চলের সকল ধর্মের মানুষ হাজার বছর থেকে সহাবস্থান করছে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিলে সেটি আমাদের ঐতিহ্যকে খাটো করা হয়।”
তিনি বলেন, “বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়। সেটি বাদ দেওয়া যাবে না।”
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম অজ্ঞাত স্থান থেকে বেনারকে বলেন, “সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ বাদ দেওয়ার বিষয়টি দেশের মানুষ মেনে নেবে না।”
তাঁর মতে, সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের “হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির” প্রতীক।
তবে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিলে কোনো সমস্যা দেখেন না বলে মন্তব্য করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা জহির উদ্দিন স্বপন।
প্রস্তাবিত ‘বহুত্ববাদ’ “সকল ধর্ম ও জাতি গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে,” বলে বেনারকে জানান তিনি।
তিনি জানান, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো হাতে পাওয়ার পর দলীয় ফোরামে আলোচনা করে তাঁরা এ বিষয়ে বিস্তারিত মতামত জানাবেন।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে কমিশন বলেছে, এক ব্যক্তি দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবে না। তিনি একইসঙ্গে দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না।
প্রতিবেদন হস্তান্তর অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “গত ১৬ বছর বাংলাদেশ যে একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার মোকাবিলা করেছে তার কারণ, ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ভারসাম্য ছিল না।”
তিনি বলেন, “কোনো একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে যাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে না পারে সে জন্য রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ এবং নির্বাহী বিভাগের দুটি পদ প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা একটি চেক অ্যান্ড ব্যালান্স হিসাবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার কথা বলেছি।”
প্রস্তাবিত জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গুরুত্বপূর্ণ পদের নিয়োগ দেবে। এর সদস্য থাকবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদের দুই কক্ষের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, বিরোধীদল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, বিরোধীদল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার এবং মনোনীত সদস্য।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে বর্তমান ব্যবস্থায় শুধু সংসদ সদস্যদের পরিবর্তে দুই কক্ষের সদস্য এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ইলেক্টরেট থাকবে। তাঁরাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবেন।
প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে প্রস্তাবিত “ক্ষমতার ভারসাম্য” রক্ষা করা প্রসঙ্গে নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, “পৃথিবীর যেখানে ওয়েস্টমিন্সটার গণতন্ত্র রয়েছে, সেখানে সরকার প্রধান ও রাষ্ট্র প্রধানের মধ্যে কি ক্ষমতার ভারসাম্য আছে? যদি সেটি করতে হয় তাহলে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় ফিরে যেতে হবে।”
তবে প্রস্তাবিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে সকল দলের সম্মতি দরকার জানিয়ে অধ্যাপক নিজাম বলেন, “কারণ এই অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো ম্যান্ডেট নেই।”
এছাড়া সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গঠনেরও প্রস্তাব করেছে কমিশন।
এ প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বুধবার বেনারকে বলেন, সরকার “ঐকমত্যের ভিত্তিতে সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে চায়।”
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলছে। এর অংশ হিসেবে মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এর মধ্যে চারটি কমিশন বুধবার প্রতিবেদন জমা দেয়।