রাজনীতি না করার শর্তে মামলা প্রত্যাহার চায় হেফাজতে ইসলাম
2022.02.15
ঢাকা

ভবিষ্যতে আর রাজনীতি নয়—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এই অঙ্গীকার করে সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ২০১৩, ২০১৬ এবং ২০২১ সালে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছে চট্টগ্রামের হাটহাজারী কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।
এদিকে হেফাজতের আরেকটি অংশ যশোরের চৌগাছা আড়ারদহ হামিউস সুন্নাহ কওমি মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে নতুন ইসলামী দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত নতুন এই রাজনৈতিক দল জাতীয় উলামা কল্যাণ পরিষদ বাংলাদেশ এর আমীর হয়েছেন আল্লামা আব্দুর রাজ্জাক, এছাড়া শহীদুল ইসলাম ইনসাফীকে দলের মহাসচিব করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান সংগঠনটির প্রেস সচিব মুশফিকুর রহমান ইনসাফী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, হেফাজতের রাজনৈতিক ব্যর্থতার পর এখন সংগঠনটির আওতায় থাকা বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে ছোট ছোট রাজনৈতিক দল গঠিত হতে পারে।
আর রাজনীতি করবে না
গত বুধবার দুপুরে সংগঠনের মহাসচিব আল্লামা সাজিদুর রহমান এর নেতৃত্বে হেফাজতের শীর্ষ ছয় নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাথে বৈঠক করেন। বিষয়টি বেনারকে নিশ্চিত করেন হেফাজতে ইসলামের প্রেস ও প্রচার সচিব মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী।
তিনি জানান, হেফাজতের শীর্ষ নেতা নায়েবে আমীর মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, আল্লামা ইয়াহইয়া, অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান, মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী, মাওলানা মীর ইদ্রিস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অংশ নেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “হেফাজতে ইসলামের সকল উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ আমার কাছে এসেছিলেন দেখা করতে। তাঁদের কথা, তাঁরা আর রাজনীতি করবেন না। বেশ নরম ও নমনীয়ভাবে কথা বলেছেন। আমরা যেন তাঁদের নেতাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার যেসব মামলা আছে, সেগুলো তুলে নেই এবং জেলে আটক নেতাদের জামিনের ব্যবস্থা করি।”
মন্ত্রী বলেন, “আমি তাঁদের বলেছি, রাজনীতি করা তো আপনাদের কাজ নয়। আপনারা তো অরাজনৈতিক সংগঠন। তাহলে রাজনৈতিক কর্মসূচি দেন কেন? তাঁরা বলেছেন, কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এগুলো আর হবে না।”
তিনি বলেন, “আমি বলেছি, আমরা মামলার বিষয়ে সরকারের সাথে আলোচনা করে জানাব। কিন্তু আটক নেতাদের জামিনের ব্যাপারে আমাদের কিছু করণীয় নেই। জামিন আদালতের বিষয়।”
হেফাজতের মাওলানা মুহিউদ্দিন জানান, “আমাদের সংগঠনের আমীর আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর পক্ষ থেকে মহাসচিব আল্লামা সাজিদুর রহমান মন্ত্রীর কাছে লিখিত কিছু প্রস্তাবনা পেশ করেন।”
তিনি বলেন, “আমরা মন্ত্রী মহোদয়কে বলেছি, আমরা রাজনীতি বুঝি না। ২০১৩, ২০১৬ এবং ২০২১ সালে দায়ের করা মামলায় আমাদের প্রায় ৫০০ নেতাকর্মী কারাগারে আছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করে তাঁদের মুক্তি দেয়ার জন্য আমরা তাঁকে অনুরোধ করি। যাঁরা কারাগারে আছেন তাঁদের জামিনের ব্যবস্থা করার জন্য আমরা তাঁকে অনুরোধ করেছি।’’
মাওলানা মুহিউদ্দিন বলেন, ২০২১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘটে যাওয়া সহিংসতার জন্য হেফাজতে ইসলামের একেক নেতার বিরুদ্ধে অনেক মামলা রয়েছে। শুধু মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীর নামেই ২৭টি মামলা রয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “ইতোমধ্যেই আমাদের কিছু কিছু নেতা জামিনে মুক্ত হয়েছেন। সেজন্য আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।”
মাওলানা মুহিউদ্দিন বলেন, “ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারত সফরকে কেন্দ্র করে আগের কমিটি রাজনীতি করেছে। আমরা অরাজনৈতিক সংগঠন। আমরা রাজনীতি করব না।’’
ভারতের সাথে ‘সুন্দর সম্পর্ক’ চায় নতুন দল
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক ইসলামি সংগঠনগুলো চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রধান আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম গঠন করে। তারা ইসলামের ‘ঈমান-আক্বিদা’ রক্ষার জন্য এই সংগঠন গঠন করে।
তবে অচিরেই এই সংগঠন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৩ সালের মে মাসে তারা নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসির দাবিতে সরকারকে চরমপত্র দেয় এবং ঢাকার মতিঝিল এবং এর আশেপাশের এলাকায় চরম নৈরাজ্য ও সহিংসতা চালায়।
সেই রাতেই পুলিশি অভিযানে খুব তাড়াতাড়ি হেফাজতের এই আন্দোলন নস্যাৎ হয়ে যায়।
তবে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, ঢাকা, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক সহিংসতা চালায়। শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় কমপক্ষে ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটে।
এই ঘটনার পর হেফাজতে ইসলামের নেতাদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা দায়ের করে সরকার। আটক করা হয় শত শত নেতাকর্মীকে।
জাতীয় উলামা কল্যাণ পরিষদ বাংলাদেশ এর প্রেস সচিব মুশফিকুর রহমান ইনসাফী বেনারকে বলেন, “হেফাজতে ইসলামীর কারণে বাংলাদেশের আলেম-ওলামা আজ অভিভাবকহীন। নতুন এই দল আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আলেম-ওলামাদের জন্য কাজ করবে এবং একইসাথে অন্যান্য ধর্মের মানুষের জন্যও কাজ করবে।”
তিনি বলেন, “আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। আমরা মনে করি ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। আমরা ভারতের সাথে সুন্দর সম্পর্ক রাখতে চাই।”
নতুন দল ‘শক্তিশালী হওয়া কঠিন’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ফ্যাক্টর। তাদের তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন রয়েছে। সুতরাং, অন্য কোনো ইসলামিক দলের পক্ষে হেফাজতের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হওয়া কঠিন।”
তিনি বলেন, “যশোরে যে ইসলামী দল আত্মপ্রকাশ করেছে সেই দলটির উদ্দেশ্য হতে পারে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে দর কষাকষি করে দুই-একটি আসনে এম.পি বানানো, যেমনটি তরিকত ফেডারেশন করেছে।”
অধ্যাপক নিজাম বলেন, “আমার মনে হয় নির্বাচন সামনে আসলে আরও ভুঁইফোড় ইসলামিক রাজনৈতিক দল সামনে আসবে, যারা বিএনপির বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কিছু আসন নেয়ার চেষ্টা করবে। আবার আওয়ামী লীগও তাদের ব্যাপারে কিছুটা আগ্রহী হতে পারে।”
অধ্যাপক নিজাম বলেন, “এটি হেফাজতে ইসলামের একটি কৌশলও হতে পারে। যেহেতু হেফাজতে ইসলাম কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সেহেতু তারা হয়ত আলাদাভাবে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার কৌশল অবলম্বন করতে পারে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে বর্তমানে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করতে না দেয়ার কারণে বিভিন্ন ভুঁইফোড় ইসলামী দল গড়ে উঠছে এবং ভবিষ্যতে আরও উঠবে।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তারেক এম. টি. রহমান বেনারকে বলেন, ‘‘যশোরে কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক যে ইসলামী রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে, সেটি নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী আমি নই।”
“কারণ, বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে দুই-আড়াই হাজার ছাত্রের মাদ্রাসা ভিত্তিক রাজনৈতিক দল কিছু করতে পারবে না। হয়ত দুই একটি আসনে তারা প্রভাব ফেলতে পারে। এর বাইরে কিছু নয়,” বলেন তিনি।