বিএনপি: খালেদা জিয়া যখন দরকার তখনই রাজনীতি করবেন

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.02.27
ঢাকা
বিএনপি: খালেদা জিয়া যখন দরকার তখনই রাজনীতি করবেন নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার অংশ হিসেবে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে যাওয়ার জন্য গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’ থেকে বের হচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ খালেদার স্বজনেরা উপস্থিত ছিলেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

খালেদা জিয়ার যখন রাজনীতি করা দরকার তখনই তিনি তা করবেন এবং এ বিষয়ে তিনি এবং তাঁর দলই সিদ্ধান্ত নেবে, ‘সরকার নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন

রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনায় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা নেই, তবে তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না—গত সপ্তাহে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এই জবাব দেন বিএনপি মহাসচিব।

খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্যের জবাবে এই প্রথম মন্তব্য করলেন দলের মহাসচিব।

খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন কিন্তু আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হওয়ায় আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না বলে ১৯ ফেব্রুয়ারি আইনমন্ত্রী মন্তব্য করেন, যা সরকারের আগের বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।

এর দুদিন পর কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকও বলেন, খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন।

সরকারি দলের নেতাদের এসব বক্তব্য প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সোমবার আলোচনা সভায় জানান, খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিভিন্ন “নাটক শুরু করেছে সরকার।”

বিএনপি মহাসচিবের অভিযোগ, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা নিয়ে সরকারের উদ্দেশ্য খারাপ। এ নিয়ে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিতে চায় ক্ষমতাসীনরা।

খালেদা জিয়া “অত্যন্ত অসুস্থ” দাবি করে অবিলম্বে তাঁর মুক্তির দাবি জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, তাঁকে “অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলায়” কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে।

উল্লেখ্য, সোমবারও হাসপাতালে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েছেন খালেদা জিয়া।

রাজনৈতিক সমঝোতার ইঙ্গিত?

গত ১২ ফেব্রুয়ারি এক আলোচনা সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে শক্তিশালী বিরোধীদলও প্রয়োজন।”

দুই মন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “আমাদের দুই সিনিয়র মন্ত্রী যা বলেছেন তা রাজনীতিতে সমঝোতা সৃষ্টি করতে পারে। আমরা চাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হোক। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক।”

তবে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য ও কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বেনারকে বলেন, “আওয়ামী লীগের দুই মন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, সেটি শুনতে ভালো। কিন্তু এগুলো তাঁদের রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু না। তাঁরা বলবে এক কথা, করবে আরেক কাজ।”

এই বিএনপি নেতা বলেন, “অবশ্যই দুই দলের সংলাপ প্রয়োজন। তবে সংলাপের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দাবি হলো, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হবে। তারা (আওয়ামী লীগ) বলুক, তারা সংসদ ভেঙ্গে দেবে, পদত্যাগ করবে। এরপর আমরা আলোচনায় যাব।”

২০০৭ সালে সামরিক সরকারের সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে খালেদা জিয়ার মোট ১৭ বছর সাজা হয় এবং তাঁকে জেলে পাঠানো হয়।

২০২০ সালের ২৫ মার্চ খালেদা জিয়ার সাজার মেয়াদ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে সরকার। হাসপাতালে শারীরিক পরীক্ষা শেষে তাঁকে গুলশানের একটি বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর তাঁর এই মুক্তির মেয়াদ কয়েক দফায় বাড়ানো হয়।

খালেদা জিয়ার মুক্তির সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ ক্ষমতাসীন দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সাংবাদিকদের বলেছিলেন খালেদা জিয়া বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিতে পারবেন। তবে তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন না।

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “দেখুন, আমি যা বলি কাগজ (নথি) দেখে বলি। কাগজের কোনো জায়গায় বলা নেই যে উনি রাজনীতি করতে পারবেন না।”

বিএনপির অংশগ্রহণ দরকার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বেনারকে বলেন, দুই মন্ত্রীর বক্তব্য বিএনপির সাথে আলোচনার পথ সৃষ্টির জন্য বলা হয়েছে কি না- তা নিশ্চিত করে বলার সময় এখনও আসেনি। তবে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং সুষ্ঠু করতে দেশে-বিদেশে চাপ রয়েছে।

তিনি বলেন, “২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন আর হবে বলে মনে হয় না। আগামী নির্বাচন অবশ্যই অংশগ্রহণমূলক হতে হবে এবং এজন্য বিএনপির অংশগ্রহণ অপরিহার্য।”

ড. শান্তনু বলেন, “আমি মনে করি দুই দলের নেতাদের উচিত পর্দার অন্তরালে কথা বলে তাদের মতপার্থক্য দূর করা।”

তবে ভিন্ন কথা বলছেন আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল। তিনি সোমবার বেনারকে বলেন, আইনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যা বলেছেন সেগুলো ভালো কথা, শুনতে খুব ভালো লাগে।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের অনেকে সুস্থধারার রাজনীতি মনে ধারণ করেন। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের দেশের দলগুলোর মধ্যে কোনো গণতন্ত্র নেই।”

অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, “আওয়ামী লীগের যে নেতা যাই বলুন না কেন, দিন শেষে শেখ হাসিনা যা বলবেন তা-ই হবে। একই প্রবণতা বিএনপির মধ্যেও রয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমার মনে হয় না যে আওয়ামী লীগের দুই মন্ত্রীর বক্তব্য বিরোধীদলকে আশ্বস্ত করার জন্য বলেছেন। বরং এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল। এই কথা বলে বোঝার চেষ্টা করছেন যে কী প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।”

আসিফ নজরুল বলেন, “এই কথাগুলো বলে আওয়ামী লীগ বিদেশিদের বোঝাতে চাইছেন যে তাঁরা বিরোধীদলকে আস্থায় নিয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা করতে চান।”

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য কৌশলটি ব্যাখ্যা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ সোমবার বেনারকে বলেন, “আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করতে পারলে আন্তর্জাতিকভাবে আরও প্রশ্নের মুখে পড়বে আওয়ামী লীগ সরকার।”

“দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ আরও উন্নত করতে আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের চাপ রয়েছে। বিদেশিরা চান, বিরোধীদল বিএনপির সাথে একটি সমঝোতায় আসুক সরকার,” বলেন তিনি।

অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন বলেন, “সে কারণে আওয়ামী লীগের কৌশল হবে, আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া। সে লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন দল রাস্তার দখল রেখেছে এবং একইসাথে একটু সুন্দর কথা বলা যাতে অবস্থা সহিংস না হয়ে ওঠে।”

অধ্যাপক নিজাম বলেন, “তবে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কিছু আদায় করতে হলে রাস্তায় আন্দোলন করে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। নতুবা বিএনপি কিছু করতে পারবে না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।