নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন: রাজনৈতিক দলগুলো কাগজে ‘হ্যাঁ’, কাজে ‘না’

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.03.28
ঢাকা
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন: রাজনৈতিক দলগুলো কাগজে ‘হ্যাঁ’, কাজে ‘না’ বিশ্ব নারী দিবসে ঢাকায় বিএনপির নারী সংগঠন জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের মিছিল। ৮ মার্চ ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন পাওয়ার শর্ত হিসাবে ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন বলেছিল, ২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে সব স্তরের কমিটিতে কমপক্ষে শতকরা ৩৩ ভাগ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। না হলে দলগুলোর নিবন্ধন বাতিল হবে।

সেই শর্ত দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও তাতে কোনো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হয়নি। এমনকি তিন বছর আগে সময়সীমা পার হলেও এব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কঠোর কোনো অবস্থান নেয়নি।

এই প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার দি রিপ্রেজেনটেশন অব দি পিপল অর্ডার-১৯৭২ (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২) এর সংশোধনী সংক্রান্ত প্রস্তাবনা অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। সংশোধনী অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলগুলোকে শতকরা ৩৩ ভাগ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ এর সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন করার সিদ্ধান্ত সাংবাদিকদের জানান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার শাখার সচিব মো. মাহমুদুল হোসাইন খান।

নীতিগতভাবে অনুমোদিত সংশোধনী প্রস্তাবটি বিল আকারে জাতীয় সংসদে পেশ করা হবে এবং সংসদে পাশ হলে তা আইনে পরিণত হয়ে এবং মূল গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ এ তা সংযোজিত হবে।

পুরুষরা চায় না নারী ক্ষমতায়িত হোক

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মতে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দল কেউই নারীকে অগ্রাধিকার কেন, সমান অধিকারও দিতে চায় না।

২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “২০৩০ সাল পর্যন্ত এই মেয়াদ বৃদ্ধিতে আমি আশ্চর্য হইনি। কোনো রাজনৈতিক দল তাদের কথা রাখেনি।”

তিনি বলেন, “নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মূল বাধা হলো আমাদের সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। পুরুষরা চায় না নারী ক্ষমতায়িত হোক। আর সত্য কথা হলো, একজন চেয়ার না ছাড়লে আরেকজন তো সেখানে বসতে পারবে না।”

রাশেদা চৌধুরী বলেন, “বর্তমানে রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে অর্থ ও পেশি শক্তি ছাড়া টিকে থাকা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলো এদের বাদ দিয়ে একজন নারীকে পছন্দ করবে, সেটিও আশা করা কঠিন।”

তিনি বলেন, “সে কারণে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের প্রথম বাধা আসে পরিবার থেকে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) প্রধান নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত সরকারের নির্দেশে ওপর থেকে বলে দেয়া হয় যে, জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের সকল স্তরের কমিটিতে কমপক্ষে শতকরা ৩৩ ভাগ নারী অন্তর্ভুক্ত করবে।”

তিনি বলেন, সেই অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের শর্ত হিসাবে এটি জুড়ে দেয়া হয় এবং এতে রাজনৈতিক দলগুলো আপত্তি জানায়নি।

অধ্যাপক কলিম উল্লাহ জানান, “এই লক্ষ্য পূরণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ১২ বছর সময় দিয়ে বলা হয়, ২০২০ সালের মধ্যে তাদের এই লক্ষ্য পূরণ করতে হবে। কিন্তু কোনো দলই এটা করতে পারেনি এবং এটি করার ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।”

তিনি বলেন, “এটি না করার কারণ হলো আমাদের মনস্তাত্ত্বিক গঠন। আমরা এখনও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করি যেখানে নারীর অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ কম।”

অধ্যাপক কলিম উল্লাহ বলেন, “এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য আমাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন দরকার। নারীদের কথা শুনতে হবে এবং তাঁদের জায়গা করে দিতে হবে।”

নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ৭৯-সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারী রয়েছেন ২০ জন অর্থাৎ শতকরা ২৫ ভাগের কম।

বিএনপির ৫০২ সদস্যের নির্বাহী কমিটিতে নারী রয়েছেন ৬৭ জন। দলের ৮২-সদস্য উপদেষ্টা পরিষদে নারী রয়েছেন মাত্র ছয় জন।

সংসদে প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টিতে নারী প্রতিনিধিত্ব শতকরা ২০ ভাগ বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।

আমরা কিন্তু পিছিয়ে নেই

প্রধান রাজনৈতিক বিরোধীদল বিএনপিতে নারী প্রতিনিধিত্ব কম থাকার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দলের মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দিন স্বপন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “নির্বাচন কমিশনের এই বিধানের প্রতি বিএনপির সমর্থন রয়েছে এবং বিএনপি দলের প্রতিটি স্তরে শতকরা ৩৩ ভাগ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে কাজ করে যাবে। এটিই মূল কথা।”

তিনি বলেন, “এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে আমরা পারলাম না কেন। এর কারণ হলো; দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক অবস্থা। গত ১৫ বছর দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ মারাত্মক অনিরাপদ হয়েছে। দেশে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের পরিবেশ নেই। কোনো মানুষের নিরাপত্তা নেই। এই পরিস্থিতিতে নারীরা রাজনৈতিক কার্যক্রমে সক্রিয় হওয়ার কথা চিন্তা করবেন না।”

জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, “রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে পর্যায়ক্রমে সকল স্তরে কমপক্ষে ৩৩ ভাগ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।”

তবে ভিন্ন কথা বলছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ফারুক খান।

মঙ্গলবার তিনি বেনারকে বলেন, “বর্তমান সময় পর্যন্ত আমরা শতকরা ৩৩ ভাগ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারিনি, সেটি সত্য। তবে আমরা কিন্তু পিছিয়ে নেই। বর্তমানে আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রায় ২৪ ভাগ নারী প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এটি পর্যায়ক্রমে আরও বাড়বে।”

ফারুক খান বলেন, “বাংলাদেশের সংসদে স্পিকার, সংসদ নেতা, উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা সবাই নারী। সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ছাড়াও ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে যা বিশ্বের অনেক দেশেই নেই।”

তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ এই বিধানকে সমর্থন করে এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে যাচ্ছে। আমি আশা রাখি আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারব।”

ফারুক খান বলেন, “তবে এটি শুধু আইনের মাধ্যমে করা সম্ভব হবে না। আইনের পাশাপাশি নারীদেরও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে হবে, জনগণের কাছে যেতে হবে, এবং তাদের মন জয় করতে হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।