নির্বাচনে ‘স্বতন্ত্র’ কৌশল: সংঘাত বেড়েছে আওয়ামী লীগে
2024.03.29
ঢাকা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে গিয়ে গত সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল নিজেদের ভেতর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তৈরি করার ফলে এ বছরের শুরু থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘাত ও সহিংসতা বেড়েছে, মারা গেছেন অন্তত ১৫ জন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলের নেতাদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি আওয়ামী লীগের জন্য বুমেরাং হয়েছে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তাঁদের আশঙ্কা, নির্বাচনের আগে বিরোধীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যেখানে সংঘর্ষের রেওয়াজ ছিল, সেখানে এখন মূলত মারামারি হচ্ছে নিজ দলের মধ্যে, যা আগামীতে আরও বাড়তে পারে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় সাত হাজার ১২১ জন আহত ও ৪৫ জন নিহত হয়েছেন।
ওই বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির ৫৫টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, তাতে ৯৭২ জন আহত ও একজন নিহত হন।
আসক আরও বলছে, চলতি বছরে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ২৪৪টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২০৫টি দল মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে এবং ১৭টি আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যে। এসব সংঘর্ষে এক হাজার ৮৭১ জন আহত ও ১৫ জন নিহত হয়েছেন। চলতি মার্চ মাসে অন্তত আরও চারজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
গত ১৩ মার্চ কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় প্রতিপক্ষের হামলায় আমিরুল ইসলাম ওরফে নান্নু নামের এক যুবক খুন হন। উপজেলার উত্তর চাঁদপুর গ্রামের একটি কলাবাগান থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে ওই এলাকায় নৌকার প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ জর্জ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুর রউফের পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলছিল।
এ বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ বেনারকে বলেন, “আমিরুল নৌকা প্রতীকের সমর্থক ছিলেন। নির্বাচনের পর থেকে তাঁরা (বর্তমান সংসদ সদস্য) আমার সমর্থকদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে আসছেন। সংসদ সদস্যর সমর্থকদের হামলায় নান্নু নিহত হয় বলে পরিবারের দাবি।” যদিও এ অভিযোগ মানতে নারাজ অভিযুক্তরা।
গত ১৬ মার্চ বরিশালের হিজলায় জামাল মাঝি (৫২) নামে আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত জামাল মাঝি ধুলখোলা ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।
জামাল মাঝিকে নিজের অনুসারী দাবি করেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পংকজ নাথ স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানান, সংসদ সদস্য প্রার্থী শাম্মী আহমেদের অনুসারীরা ওই হত্যায় জড়িত। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন শাম্মী আহমেদের অনুসারীরা।
রাজনৈতিক মানের ‘অবনতি’
গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার পাশাপাশি দলের লোকজনকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দিয়েছিল জানিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও ব্যাপক ভোটার উপস্থিতি দেখানোর জন্য এই কৌশল নেওয়া হলেও তা থেকে সহিংসতার সূত্রপাত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এখন সংসদ সদস্য হওয়া বা দলীয় পদ পাওয়াটা খুবই সহজ ও আকর্ষণীয় বিষয়। রাজনীতিটা পুরোপুরি ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। দলীয় পদ-পদবি পেলে বিভিন্ন ধরনের ফায়দা চেইনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যায়; অন্যায় সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। এটা আমাদের রাজনৈতিক মানের বড়ো অবনতি।”
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৬৬ আসনে প্রার্থী দিয়ে ২২২টিতে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। ২৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করলেও বিএনপি এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে। স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ৪৩৬ জন, যার অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতা।
নির্বাচনে জয়ী ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে ৫৯ জন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত। এই নির্বাচনকে বিরোধীরা ‘ডামি নির্বাচন’ বলে আখ্যা দিয়ে আসছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বেনারকে বলেন, “নির্বাচনকে সামনে নিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় নীতি, দলের সিদ্ধান্তের বাইরেও স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে; এই সিদ্ধান্তের কুফল হিসেবে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হোন আর দলীয় প্রার্থী হোন প্রতিপক্ষকে সহ্য করার ব্যাপারে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করেছেন। গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির ধার-ধারছেন না তাঁরা। এটা দলের জন্য অমঙ্গলজনক এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য অশুভ ইঙ্গিত।”
গত ২৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে উপস্থিত হয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থন জানান স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা।
‘নির্বাচনটা হওয়ার দরকার ছিল’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “নির্বাচনটা হওয়ার দরকার ছিল। যেহেতু অন্যরা নির্বাচন করল না, সেহেতু আমাদের নিজেদের মধ্যে নির্বাচনের এই প্রক্রিয়া ছিল একটা রাজনৈতিক কৌশল। এই কৌশলে আমরা সফল হয়েছি।”
আওয়ামী লীগ মনোনীত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকদের সংঘর্ষ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এতে আমাদের দলের শৃঙ্খলা অনেকটা বিঘ্নিত হয়েছে। এটা মেরামত করতে হবে এবং তা সম্ভব। দলের পক্ষ থেকে নির্দেশনা আছে এবং আমরা সর্বোচ্চ তৎপর রয়েছি।”
শাজাহান খান আরও বলেন, “যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে এলো না, সেহেতু একটি নতুন পরিস্থিতি তৈরি হলো। সব রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচন করতো তাহলে কিন্তু চিত্রটা ভিন্ন হতো। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমাদের নিজেদের মধ্যে কিছু লোক নির্বাচনে জিততেই হবে এমন মানসিকতা পোষণ করায় কিছু জায়গায় ঝামেলা হয়েছে।”