স্বতন্ত্র বনাম সরকার দলীয় প্রার্থী: উত্তপ্ত গাজীপুর সিটি নির্বাচন

আহম্মদ ফয়েজ
2023.05.22
ঢাকা
স্বতন্ত্র বনাম সরকার দলীয় প্রার্থী: উত্তপ্ত গাজীপুর সিটি নির্বাচন আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রচারে পুলিশ বাধা দেওয়ার পর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। ১৩ মে ২০২৩।
[সৌজন্যে: ফেসবুক/জায়েদা খাতুন সমর্থক গোষ্ঠী]

গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে ঘিরে জাতীয় রাজনীতিতে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই নির্বাচন বয়কট করলেও নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীকে ঠেকাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

ঢাকার নিকটবর্তী গাজীপুরের মহানগরের এই সিটি নির্বাচনে দল থেকে বহিষ্কৃত ও পদ থেকে বরখাস্ত গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনই হয়ে উঠেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লা খানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।

নিজে প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করেও ঋণ খেলাপি হওয়ার অভিযোগে মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ার পর প্রার্থিতা টিকে থাকা মায়ের নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়ক হয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন জাহাঙ্গীর।

সেনা মোতায়েন চেয়ে কূটনীতিকদের কাছে জায়েদা চিঠি

আগামী ২৫ মে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে কূটনীতিকদের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও সেনা মোতায়েনের জন্য ইসিকে প্রভাবিত করার অনুরোধ জানিয়ে কয়েকটি দূতাবাসে চিঠি পাঠিয়েছেন জাহাঙ্গীরের মা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা।

রোববার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনারকে এই চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন জায়েদা।

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীর বেনারকে বলেন, “অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থেই এই চিঠি দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের শুরু থেকেই আমি ও আমার মা কয়েকবার হামলার মুখে পড়েছি।”

এ দিকে গাজীপুরের এই নির্বাচন সম্পর্কে সোমবার নির্বাচন কমিশনার মো: আলমগীর ঢাকায় নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি আছে তাতে কেবল বাংলাদেশ নয়, এই উপমহাদেশের বিবেচনায় অত্যন্ত ভালো আছে।

স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের প্রচারণায় দুই দফা হামলার বিষয়ে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, তাঁর এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাইনি।

ভোটের দিনের প্রস্তুতি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনার আলমগীর বলেন, ভোট কেন্দ্রে যেতে ভোটারদের যদি বাধা দেয়া হয় তবে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রত্যেকটা বুথে সিসি ক্যামেরা থাকবে জানিয়ে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, “ঢাকায় বসে সিইসিসহ অন্যান্য কমিশনার, কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকরা তা পর্যবেক্ষণ করবেন। কোনো অভিযোগ দেখলে আইনে যেভাবে ব্যবস্থা নেয়ার কথা সেভাবেই নেওয়া হবে।”

হামলা হচ্ছে জাহাঙ্গীর ও তাঁর মায়ের প্রচারণায়

নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর থেকেই নানা স্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্মীদের হামলার মুখে পড়ছেন জাহাঙ্গীর ও তাঁর মা জায়েদা।

সর্বশেষ গত শনিবার বিকেলে প্রচারণা চালাতে গিয়ে টঙ্গী এলাকায় হামলার মধ্যে পড়েছেন জায়েদা খাতুন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় টঙ্গীর পূর্ব গোপালপুর এলাকায় জায়েদার গণসংযোগে ব্যবহৃত গাড়িতে হামলা করা হয়।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে টঙ্গী পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আশরাফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, টঙ্গী এলাকায় জায়েদা খাতুনের প্রচারণায় হামলার বিষয়ে পুলিশ কোনো লিখিত অভিযোগ পায়নি।

“তবে নির্বাচনে প্রার্থীরা যেন নির্বিঘ্নে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যেতে পারেন তার জন্য সর্বোচ্চ তৎপর রয়েছে পুলিশ। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি সংখ্যক পুলিশ সদস্য মাঠে মোতায়েন রয়েছে,” বলেন আশরাফুল।

জাহাঙ্গীরের মায়ের ওপর বারবার হামলার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লা সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, জাহাঙ্গীর এসব হামলার নাটক করছেন।

তিনি বলেন, “মিথ্যাচার করে লাভ হবে না। ভোটের পরিবেশ অনেক সুন্দর আছে।”

বিভিন্ন দূতাবাসে চিঠি দিয়ে ভোটের পরিবেশ নিয়ে জাহাঙ্গীর ও তাঁর মা মিথ্যাচার করছেন বলে দাবি করেন আজমত উল্লা।

জাহাঙ্গীরকে দুদকের তলব

গাজীপুরে যখন নির্বাচনী প্রচার প্রচারণায় ভোটের মাঠ সরগরম সে সময় দুটি দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জাহাঙ্গীরকে তলব করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

রোববার ও সোমবার ছিল জাহাঙ্গীরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নির্ধারিত দিন। জিজ্ঞাসাবাদ এক মাস পেছানোর আবেদন করেও দুদকের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে রোববার দুপুরে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এসে হাজির হন জাহাঙ্গীর।

পরে দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আলী আকবর জানান, “জাহাঙ্গীরের আবেদন পেয়েছেন এবং সময় পেছানোর বিষয়টি আইন অনুযায়ী আমলে নিয়েছে দুদক।”

এ সময় জাহাঙ্গীর সাংবাদিকদের বলেন, “শুধু হয়রানি করার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিকভাবে আমার বিরুদ্ধে দুদককে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি যখন আমার মায়ের নির্বাচনে প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছি সে সময় প্রচারণার মাঠ থেকে আমাকে দূরে রাখতেই এই ষড়যন্ত্র।”

জাহাঙ্গীরের এই অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদক সচিব মাহবুব হোসেন বেনারকে বলেন, “উনার (জাহাঙ্গীর) রাজনৈতিক বক্তব্যের বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। উনাকে তলবের মূল কারণ হচ্ছে আমাদের অনুসন্ধান দুটি শেষ পর্যায়ে এবং এই পর্যায়ে নিয়ম মতেই তাঁর বক্তব্য গ্রহণ প্রয়োজন।”

যেভাবে দল ও পদ থেকে ছিটকে পড়লেন জাহাঙ্গীর

গত বছরের সেপ্টেম্বরে মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও ক্লিপে শোনা যায় টেলিফোনের অপর প্রান্তে একজনের সঙ্গে আলাপকালে মেয়র জাহাঙ্গীর বলছেন, “আমাদের বঙ্গবন্ধু ৩০ লাখ (মুক্তিযোদ্ধা) মারাইছে। ৬৪ জেলার প্রতিটিতে ৪৫ হাজার করে মরেছে। তাঁর স্বার্থ উদ্ধার করে নিয়েছে।”

ব্যক্তিগত আলাপের এই ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি উঠে দলের মধ্যেই।

পরবর্তীতে ৩ অক্টোবর জাহাঙ্গীর আলমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এবং তাঁর বক্তব্য দলকে সন্তুষ্ট করতে না পারায় ঢাকায় আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের এক বৈঠকে জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় দল।

দল থেকে বহিষ্কারের চার দিনের মাথায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পর থেকেও বরখাস্ত করা হয় জাহাঙ্গীরকে।

পরবর্তীতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার শর্তে ক্ষমা করে জাহাঙ্গীরকে দলে ফেরত নেওয়া হয়।

কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর গত ১৬ মে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে জাহাঙ্গীরকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের কথা জানানো হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।