দলের প্রতিষ্ঠাতা ‘হত্যায়’ অভিযুক্ত বাবুনগরী হেফাজতের প্রধান, বাদ পড়েছেন বিতর্কিতরা

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.06.07
ঢাকা
দলের প্রতিষ্ঠাতা ‘হত্যায়’ অভিযুক্ত বাবুনগরী হেফাজতের প্রধান, বাদ পড়েছেন বিতর্কিতরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে ঢাকার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সামনে হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভ কর্মসূচি। ২ এপ্রিল ২০২১।
[বেনারনিউজ]

মাত্র পাঁচ দিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে আহমদ শফী ‘হত্যাকাণ্ডে’ জড়িত থাকার অভিযোগে হেফাজতে ইসলামের শফীপন্থী নেতারা জুনায়েদ বাবুনগরীকে গ্রেপ্তারের দাবি জানালেও তাঁরই নেতৃত্বে সোমবার ৩৩ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করেছে সরকার বিরোধী হিসাবে পরিচিত হেফাজতের বাবুনগরী গ্রুপ।

নতুন কমিটির সভাপতি জুনায়েদ বাবুনগরী, মহাসচিব তাঁরই আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত নুরুল ইসলাম, সহকারী মহাসচিব করা হয়েছে শফীপুত্র ইউসুফ মাদানীকে, যদিও সোমবারই ইউসুফ এই পদ প্রত্যাখ্যান করেছেন। 

তবে কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন সম্প্রতি নারী কেলেঙ্কারিতে আলোচিত সাবেক যুগ্মমহাসচিব মামুনুল হকসহ মার্চে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় সংশ্লিষ্ট ও আটক উল্লেখযোগ্য অনেক নেতা। 

গত ২৬ এপ্রিল কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়, বিলুপ্ত কমিটি ও আহ্বায়ক কমিটির মূল নেতৃত্বে ছিলেন জুনায়েদ বাবুনগরী, নতুন কমিটিরও প্রধান তিনি। 

রাজধানীর খিলগাঁও মাখজানুল উলুম মাদরাসায় সোমবার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়।

এদিকে বাবুনগরীর বিরুদ্ধপক্ষ আহমদ শফীর আরেক পুত্র আনাস মাদানী সোমবার বেনারকে বলেন, তাঁরা এই কমিটি মানেন না। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন।

“আজকে যে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে এই কমিটি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়,” মন্তব্য করে আনাস মাদানী সোমবার বেনারকে বলেন, “আল্লামা আহমদ শফী যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১০ সালে হেফাজতে ইসলাম গঠন করেছিলেন এই নতুন কমিটিতে যাঁরা আছেন তাঁদের দিয়ে সেই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়।”

তিনি বলেন, “এই কমিটিতে যাঁরা আছেন তাঁদের অনেকেই আল্লামা শফীকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত। পুলিশ তদন্ত করে ওই হত্যাকাণ্ডের সাথে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে।”

“আবার অনেকেই আছেন যাঁরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে ভাংচুর, সহিংসতা, নৈরাজ্যকর কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত,” যোগ করেন তিনি।

সোমবার কমিটি করার আগে তাঁদের সাথে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি জানিয়ে আনাস মাদানী বলেন, “একতরফা এই কমিটি প্রত্যাখ্যান করছি।” 

প্রসঙ্গত, গত ২ জুন ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আহমদ শফী ‘হত্যাকাণ্ডে’ সম্পৃক্ত থাকার দায়ে জুনায়েদ বাবুনগরীর গ্রেপ্তার দাবি করেছিলেন শফীপুত্র আনাস মাদানী-সমর্থক নেতারা। নতুন কমিটি ঘোষণা দেয়া হবে বলেও তখন জানিয়েছিলেন তাঁরা।

তাঁদের পক্ষ থেকে কোনো পাল্টা কমিটি গঠন করা হবে কি না জানতে চাইলে “সিনিয়র নেতারা বসে অচিরেই করণীয়” ঠিক করবেন বলে জানান আনাস মাদানী। 

‘শক্ত অবস্থান নেওয়ার ক্ষমতা হেফাজতের নেই’

২০১০ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রধান আহমদ শফী ‘দেশে ইসলাম রক্ষা করতে’ গঠন করেন কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ছিলেন জুনায়েদ বাবুনগরী। 

প্রতিষ্ঠার পর সংগঠনটি বাংলাদেশে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগারদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগারদের নাস্তিক হিসাবে আখ্যা দিয়ে তাঁদের ফাঁসির দাবিতে সরকারকে এক মাসের সময় বেঁধে দেয়।

সরকার সেই দাবি না মানলে ২০১৩ সালের ৫ মে সারাদেশ থেকে মাদ্রাসা ছাত্রদের ঢাকায় এনে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলে অবস্থান নেয় হেফাজত। ৬ মে প্রথম প্রহরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হেফাজতের অবস্থান কর্মসূচি পণ্ড করে দেয়। ওই ঘটনায় হেফাজতের নেতাদের বিরুদ্ধে ৮৩টি মামলা দায়ের করে সরকার। তবে সরকারের সাথে আপসের কারণে সেই মামলার তদন্ত বন্ধ ছিল।

গত বছর সেপ্টেম্বরে হেফাজতের সদর দপ্তর হাটহাজারী মাদ্রাসায় শফী বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। তিন দিনের আন্দোলনের মুখে শফী পদত্যাগ করেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রায় একশ বছর বয়সী আহমদ শফী। উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হলে ১৮ সেপ্টেম্বর মারা যান তিনি। 

আহমদ শফীর পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ আসে, জুনায়েদ বাবুনগরীর সমর্থকেরা আহমদ শফীকে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন এবং তিনি অসুস্থ হলে তাঁকে ওষুধ দেয়া হয়নি, অ্যাম্বুলেন্স আনতে দেরি করা হয়েছে এবং তাঁর অক্সিজেন মাস্ক খুলে দেয়া হয়েছে।

এই অভিযোগে জুনায়েদ বাবুনগরীসহ তাঁর সমর্থকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন তাঁর শ্যালক মাওলানা মহিউদ্দিন। আদালত এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)। 

শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতের সভাপতি হন জুনায়েদ বাবুনগরী, গত বছর ১৫ নভেম্বর বাবুনগরীর হাতে নেতৃত্ব যাওয়ার পর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে যায় হেফাজত।

গত বছরের শেষ দিকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতায় নেমে আলোচনায় আসেন হেফাজত নেতা মামুনুল হক। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার হুমকি দেন।

এ বছর ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজতের নেতা–কর্মীরা প্রথমে ঢাকার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে এবং পরে হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যাপক সহিংসতা চালায়। তিন দিনের সহিংসতায় কমপক্ষে ১৮ জন মারা যান।

এই সহিংসতা দায়ে কয়েক ডজন মামলা হয়েছে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে। নতুন মামলা ছাড়াও ২০১৩ সালের সহিংসতার মামলা তদন্ত শুরু করে পুলিশ। আটক করা হয়েছে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় দুই ডজন নেতাকে।

১৩ এপ্রিল শফীর মৃত্যু তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে পিবিআই। তদন্তে বলা হয়, আহমদ শফীকে হত্যা করা হয়েছে এবং এই হত্যা মামলায় জুনায়েদ বাবুনগরীসহ ৪৩ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। তবে বাবুনগরী এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

এমতাবস্থায় এপ্রিলের শেষ দিকে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি বাতিল করে পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন জুনায়েদ বাবুনগরী।

তবে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার মতো কোনো ক্ষমতা হেফাজতের অবশিষ্ট নেই বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।

এ প্রসঙ্গে রাজনীতি গবেষক ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “ইসলামিক শক্তি হিসাবে বাংলাদেশে হেফাজতের আর কোনো অবস্থান নেই। মানুষের কাছে এই সংগঠনের আর কোনো মূল্য নেই। সুতরাং হেফাজতে বাবুনগরী থাকলেই বা কী আর না থাকলেই বা কী!”

“সরকারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার মতো কোনো ক্ষমতা হেফাজতের নেই,” বলেন আফসান চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।