খালেদা-তারেকের পর এবার জোবায়দার জেল

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.08.02
ঢাকা
খালেদা-তারেকের পর এবার জোবায়দার জেল জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রী জোবায়দা রহমানের কারাদণ্ড ঘোষণার পর রায়ের বিরুদ্ধে ঢাকার জজ আদালত চত্বরে জুতা প্রদর্শন করে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের বিক্ষোভ। ২ আগস্ট ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

জ্ঞাত উৎসের বাইরে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম‌্যান তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রী জোবায়দা রহমানকে কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত।

প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন‌্য তারেক রহমানকে নয় বছর এবং স্বামীকে সহযোগিতা করা ও তথ‌্য গোপন করায় স্ত্রী জোবায়দা রহমানকে তিন বছর সাজা দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া তারেক রহমানকে তিন কোটি টাকা ও জোবায়দা রহমানকে ৩৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছে আদালত।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান এ রায় ঘোষণা করার সময় আদালতের বাইরে দুই দলের সমর্থক আইনজীবীদের স্লোগান-পাল্টা স্লোগানে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

দণ্ড দেওয়ার প্রতিবাদে আগামী শুক্রবার বেলা দুইটায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে দলটি।

এই মামলাসহ মোট চারটি ফৌজদারি মামলায় তারেক রহমান সাজাপ্রাপ্ত হলেও প্রথমবারের মতো দণ্ড পেলেন তাঁর স্ত্রী জোবায়দা রহমান। জোবায়দা তারেকের অনুপস্থিতিতে রাজনীতিতে আসবেন-এমন জল্পনা-কল্পনা চলছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ‌্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ‌্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন আগেই। এবার তারেকের স্ত্রী জোবায়দাও সাজাপ্রাপ্ত হলেন। তার মানে হলো, জিয়া পরিবারের সবাই দুর্নীতির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত, যা ক্ষমতাসীনদের রাজনীতির জন‌্য সুবিধা হবে।”

তিনি বলেন, “খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে জোবায়দাকে বিএনপির পরবর্তী নেতা করা হতে পারে-এমনটি অনেকেই বলে আসছেন। যদিও এ ব‌্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো কথা দলের পক্ষ থেকে বলা হয়নি। তবে এই রায়ের ফলে সেই সম্ভাবনাও রইল না। তিনি চাইলেও আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।”

“দেশের বৃহত্তর অংশের মানুষ মনে করেন, এই মামলাগুলো রাজনৈতিক,” বলেন অধ‌্যাপক নিজাম।

আইনজীবীদের পাল্টাপাল্টি সমাবেশ

দুপুর ২টার পরে রায় ঘোষণার কথা থাকলেও সকাল থেকেই বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা তারেক রহমান ও জোবায়দা রহমানের ছবি সম্বলিত পোস্টারসহ মানববন্ধন করে তাঁদের পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন।

রায় ঘোষণার পরপরই তাঁরা বিক্ষোভ করেন এবং “...শেখ হাসিনার রায় মানি না, মানব না” বলে স্লোগান দিতে থাকেন। অন‌্যদিকে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন।

পুরান ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে দুই দলের সমর্থক আইনজীবীদের স্লোগান-পাল্টা স্লোগানে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ‌্যে শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতি। সম্ভাব্য সহিংসতা ঠেকাতে মোতায়েন করা হয় বাড়তি পুলিশ।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারায় সাজা হয়েছে।

বিএনপিপন্থী আইনজীবী মাসুদ তালুকদার আদালতে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা সরকারের আজ্ঞাবহ এই রায় মানি না। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এই রায় দেওয়া হয়েছে।”

তবে তাঁরা উচ্চ আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন কি না সে বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি।

রায় হওয়ার আগেই আদালত প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ করা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপিপন্থী আইনজীবী জয়নুল আবেদীন মেসবাহ বুধবার বেনারকে বলেন, “আমাদের প্রতিবাদের কারণ হলো যে, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে তারেক রহমান এবং তাঁর স্ত্রী জোবায়দা রহমানকে মিথ‌্যা মামলায় সাজা দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে।”

“এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এই মামলার সাক্ষ‌্যগ্রহণ শেষ করা হয়েছে। সরকার আদালতকে প্রভাবিত করছে,” বলেন তিনি।

তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল বেনারকে বলেন, “তারা দ্রুত কীভাবে দেখলেন! ২০০৭ সালে এই মামলা হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে আদালতে হাজির হতে বলা হলেও তাঁরা পলাতক থেকেছেন।”

এদিকে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীদের “নৈরাজ‌্য প্রতিহত” করতে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরাও সকাল থেকে আদালত প্রাঙ্গণে পাল্টা সমাবেশ করে শেখ হাসিনার পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন।

“আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পেরেছে যে, তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রী জোবায়দা রহমান জ্ঞাত উৎসের বাইরে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন,” বেনারকে বলেন আওয়ামীপন্থী আইনজীবী রফিকুল ইসলাম।

মামলার প্রেক্ষাপট

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুটি মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবার পর দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম‌্যান হন সস্ত্রীক লন্ডনে অবস্থানরত তাঁর একমাত্র জীবিত ছেলে তারেক রহমান। 

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল বিএনপি।

নির্ধারিত পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করে ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে পদত্যাগ করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন খালেদা জিয়া।

বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে আওয়ামী লীগসহ দেশের প্রায় সব দল ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্থগিত করেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। জারি করেন জরুরি অবস্থা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় সেনা সমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাসহ শত শত রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন।

আটক হন খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা, তারেক রহমানসহ অনেক রাজনীতিক। পরে তাঁদের প্রায় সবাইকে মুক্ত করে দেয় সরকার।

প্রায় দেড় বছর কারাভোগের পর সরকারের সঙ্গে আপসের মাধ্যমে সপরিবারে লন্ডন চলে যান তারেক রহমান।

ঢাকার কাফরুল থানায় ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারেক রহমান ও জোবায়দা রহমানের ঘোষিত আয়ের বাইরে চার কোটি ৮১ লাখ টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ রাখার অভিযোগে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন।

এই মামলায় জোবায়দা রহমানের মা ইকবাল মান্দ বানুকেও আসামি করা হয়েছিল। পরের বছর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় কমিশন। এই সময় ইকবাল মান্দ বানুকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

অভিযোগপত্র জমা হওয়ার পর মামলা বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়। ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল মামলা বাতিলের আবেদন খারিজ করে রায় দেয় উচ্চ আদালত। এর ধারাবাহিকতায় নিম্ন আদালতে এই মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়।

উল্লেখ্য, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে চারটিতে তাঁর সাজা হয়েছে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন তারেক।

এছাড়া, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করার মামলায় দুই বছর, একটি অর্থ পাচার মামলায় সাত বছর এবং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছর সাজা হয়েছে তাঁর।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।