জিয়ার সমাধিতে মরদেহ নেই: প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.08.27
ঢাকা
জিয়ার সমাধিতে মরদেহ নেই: প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবন সংলগ্ন চন্দ্রিমা উদ্যানে বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিতে মোনাজাত করছেন বিএনপির নেতৃবৃন্দ। ২৫ আগস্ট ২০২১।
[বেনারনিউজ]

জাতীয় সংসদ ভবন সংলগ্ন চন্দ্রিমা উদ্যানে অবস্থিত সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিতে তাঁর মরদেহ নেই বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ওই বক্তব্যের মধ্যে জিয়ার সমাধি ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করার ইঙ্গিত পাচ্ছেন বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ। 

চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের লাশ নেই-এই বক্তব্যের পেছনে আওয়ামী লীগের “অপরাজনীতি আছে,” বলে শুক্রবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। 

তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের মধ্যে এক নেতা আরেক নেতার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। বরিশালে মেয়রের সাথে ইউএনও’র দ্বন্দ্ব। কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা এবং জাসদ প্রধানের দ্বন্দ্ব। করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ সরকার—এসব বিষয় থেকে জনগণের নজর সরাতে জিয়াউর রহমানের লাশ কবরে নেই বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী।” 

“এই বক্তব্যের মাধ্যমে উনি রাজনীতিতে একটি উস্কানি দিয়েছেন যাতে আমরা বিএনপি প্রতিক্রিয়া দেখাই। আবার, সরকার চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে জিয়াউর রহমানের লাশ সরিয়ে নেয়ার চেষ্টাও করতে পারে। তবে এমন ঘোষণা দিলে বিএনপির নেতাকর্মীরা ঘরে বসে থাকবে না। তখন তাদের ওপর আবার দমন-নিপীড়ন শুরু করতে পারবে সরকার,” বলেন আলাল। 

গত ১৭ আগস্ট চন্দ্রিমা উদ্যান বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরে গিয়েও ওই যে মারামারি করল বিএনপি…বিএনপি জানে না যে সেখানে জিয়ার কবর নাই? জিয়া নাই ওখানে? জিয়ার লাশ নাই? তারা তো ভালোই জানে। তাহলে এত নাটক করে কেন?” 

২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিয়ার কবরে তাঁর মরদেহ আছে কিনা, সেই সন্দেহ পোষণ করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। ২০১০ সালের ২২ জানুয়ারি বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছিল। 

এদিকে রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসস জানিয়েছে, শুক্রবার চট্টগ্রামে এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যকে “একটি সত্য কথা” হিসেবে আখ্যায়িত করে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, “চন্দ্রিমা উদ্যানে আসলে জিয়াউর রহমানের কোনো লাশ নাই।” 

তিনি বলেন, “রাঙ্গুনিয়ার পোমরা ইউনিয়নে নাকি জিয়াউর রহমানকে প্রথম কবর দেয়া হয়েছিল। সেখানেও জিয়াউর রহমানকে কবর দিতে কেউ দেখেনি, একটা বাকশো দেখেছিল।” 

“সেদিনকার প্রত্যক্ষদর্শী বর্তমানে সেই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কুতুব উদ্দিন, তিনিও আমাকে জানিয়েছেন, তাঁরা জিয়ার মরদেহ দেখেননি,” জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “তথাকথিত প্রথম কবরেও আসলে জিয়াউর রহমানের লাশ কেউ দেখে নাই।” 

অবশ্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেনারকে বলেন “জিয়াউর রহমান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আমরা প্রত্যাখ্যান করি, নিন্দা জানাই। তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তাঁর মাজার সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন সেটি হাস্যকর এবং জনগণ সেটি বিশ্বাস করে না।” 

“শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রণাঙ্গনে থেকেই যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন,” মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, “মানিক মিয়া এভিনিউয়ে তাঁর জানাজায় লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছে তিনি দেশের মানুষের কাছে কত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন।” 

তবে “একজন প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো কথা বলেন তিনি সত্য জেনেই বলেন,” মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “বর্তমান চন্দ্রিমা উদ্যানের যেখানে জিয়াউর রহমানের সমাধি সেখানে জিয়াউর রহমানের লাশ ছিল না সেটি সত্য কথা।” 

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর সংসদ ভবন প্রাঙ্গণ থেকে জিয়াউর রহমানের লাশ সরিয়ে নেয়া হবে কি না সে ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “সময় সব কিছু বলে দেয়। অপেক্ষা করুন।” 

'বড়ো রাজনীতি আছে'

স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ৩ নভেম্বর একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। 

সংবিধানে বিধান না থাকলেও হ্যাঁ-না ভোটের মাধ্যমে দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তিনি। গঠন করেন বিএনপি। তবে ১৯৮১ সালের ৩১ মে রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে আরেক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নিহত হন জেনারেল জিয়া। 

মৃত্যুর পর প্রথমে চট্টগ্রামে তাঁর লাশ সমাহিত করা হয়। তবে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে তৎকালীন সরকার তাঁর লাশ তুলে সংসদ ভবনের উত্তর প্রান্তে ক্রিসেন্ট লেকের ধারে সমাহিত করে। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী যখন জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে কথা বলেছেন এর মধ্যে অবশ্যই বড়ো রাজনীতি আছে।” 

তিনি বলেন, “জাতির পিতার সমাধি ঢাকার বাইরে। অথচ জিয়াউর রহমানের সমাধি সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে—এটি আওয়ামী লীগের জন্য মেনে নেয়া কঠিন।” 

“এই সমাধি এখান থেকে সরিয়ে নেয়ার আলোচনা আগেও হয়েছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “সরকার যদি জিয়াউর রহমানের সমাধি সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয় তবে আমি আশ্চর্য হব না।” 

তাঁর মতে, সংসদ ভবনের সামনে এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসার পাশের উদ্যানে জিয়ার সমাধি মেনে নেয়া “আওয়ামী লীগের জন্য মনস্তাত্ত্বিকভাবে কঠিন ব্যাপার।” 

“সমাধি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনার মধ্যে আরেকটি রাজনীতি থাকতে পারে। সেটি হলো, সমাধিতে প্রকৃতই জিয়াউর রহমানের লাশ থাকুক বা না থাকুক এই সমাধি বিএনপির রাজনীতিতে ঐক্যের প্রতীক। সেখানে গিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হন,” বলেন অধ্যাপক নিজাম। 

জিয়ার সমাধি সরিয়ে ঢাকার বাইরে নেওয়া হলে তা বিএনপিকে রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে বড়ো ধাক্কা দেবে জানিয়ে তিনি বলেন, “সরকার হয়তো আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এই উদ্যোগ নিতেও পারে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।