গণপিটুনিতে ২৪ ঘণ্টায় ৩ জনকে হত্যা

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.09.19
ঢাকা
গণপিটুনিতে ২৪ ঘণ্টায় ৩ জনকে হত্যা সারাদেশে মব হামলা ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে একদল শিক্ষার্থীর মানববন্ধন। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
[বেনারনিউজ]

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতাকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ককে বহিষ্কারের কথা জানিয়েছে সংগঠনটি।

একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

প্রায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই দুটি ঘটনা ছাড়াও পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে এক যুবককে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে।

পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগের মধ্যে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানোর একদিন পরই অমানবিক নির্যাতনের এই ঘটনাগুলোতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টা এবং শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া একাধিক শীর্ষ নেতা এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। পাশাপাশি তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন তারা।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসলেও মব অ্যাটাক, গণপিটুনি বা সহিংসতার মতো ঘটনাগুলো খুব একটা নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বৃহস্পতিবার বলেছেন, “একজন অন্যায় করলে তাঁকে আইনের হাতে সোপর্দ করুন। আইন হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারো নেই।”

খাবার খাইয়ে পিটিয়ে হত্যা

পুলিশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, বুধবার রাত আটটার দিকে বরগুনার পাথরঘাটা এলাকার বাসিন্দা তোফাজ্জল হোসেনকে চোর সন্দেহে ফজলুল হক হলের মাঠ থেকে আটক করে শিক্ষার্থীরা। তোফাজ্জলকে হলের অতিথি কক্ষে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং মারধর করা হয়।

এতে তোফাজ্জল অসুস্থ হলে তাঁকে ক্যান্টিনে নিয়ে খাবার খাওয়ানো হয়। পরে মোবাইল ও মানিব্যাগ চুরির সন্দেহে তাঁকে নির্দয়ভাবে মারধর করে কিছু শিক্ষার্থী। রাত ১২টার পরে আহত অবস্থায় তোফাজ্জলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় আজ বিকেলে ছয় শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ। এছাড়া হল কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আগামীকাল শুক্রবারের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

জানা যায়, আটকৃতদের মধ্যে একজন ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন।

নিহত তোফাজ্জল বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন।

পাথরঘাটা আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “তোফাজ্জলের নিহত হওয়ার ঘটনা ফেসবুকের মাধ্যমে জেনেছি। এই ছেলে রাজনীতি করত। তবে মানসিকভাবে সুস্থ ছিল না।”

দফায় দফায় পেটানো

বৃহস্পতিবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় ছা্ত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লার হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করে।

এতে বলা হয়, বুধবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেটে কিছু মানুষের হাতে গণপিটুনির শিকার হন শামীম। বিষয়টি জানার পর ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ তাঁকে প্রক্টর অফিসে আনা হয়।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই তাঁকে পাশের নিরাপত্তা কক্ষে নিয়ে যায় কিছু ব্যক্তি। সেখানে শামীমকে আরেক দফা পেটানো হয়। সেখান থেকে আহত অবস্থায় তাঁকে প্রক্টর অফিসে আনা হয়। রাত আটটার দিকে শামীমকে আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়।

রাত আনুমানিক ১০টার দিকে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানায়, গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে প্রাণ হারিয়েছেন শামীম মোল্লা।

শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আট শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একইসঙ্গে ওই ঘটনা তদন্তের জন্য ছয় সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এ বি এম আজিজুর রহমান অফিস আদেশে এ তথ্য জানান। বহিষ্কৃতদের মধ্যে দুইজন ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে শামীমকে পেটানো হয়।

এ সহিংস ঘটনায় অংশ নেওয়ার অভিযোগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আহসান লাবিবকে অব্যাহত দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সংগঠনের এক বিবৃতিতে বলা হয়, তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে লাবিবের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের আহবান জানায় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন।

খাগড়াছড়িতে গণপিটুনিতে নিহতের ঘটনায় সংঘর্ষ

পুলিশ জানায়, বুধবার রাতে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি সদরের নোয়াপাড়া এলাকায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকালয়ে মোটরসাইকেল চোর সন্দেহে বাঙালি যুবক মো. মামুনকে (৩০) পিটিয়ে আহত করা হয়। খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ‘পাহাড়ি ও বাঙালিদের’ মধ্যে সংঘর্ষ থেকে স্থানীয় বাজারে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

জেলা পুলিশ সুপার আরিফিন জুয়েল বিকালে সাংবাদিকদের বলেন, “সেখানে পাহাড়ি-বাঙালি উত্তেজনা চলছিল। এ সময় দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে এবং দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনায় দুজন আহত হয়েছেন।”

জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার পর পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।

কঠোর না হওয়ার ফল: বিশ্লেষক

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়ায় দেশে গণবিচারের নামে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বেনারকে বলেন, “যে কোনো গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে একটি ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়। তখন সবাই নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করে মবোক্রেসি চালায়।”

তিনি বলেন, “স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর দেড় মাস হয়েছে। কিন্তু সারাদেশে নৈরাজ্য বন্ধ হয়নি। সার্বিকভাবে আমরা বর্তমানে বাংলাদেশে শক্ত একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো দেখছি না।”

অধ্যাপক সাব্বির বলেন, “বর্তমানে রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান যে কাজ করছে না তার একটি বড়ো প্রমাণ হলো পুলিশ ঠিক মতো কাজ করছে না। ফলে প্রতিদিনই মবোক্রেসি চলছে। অনেকের প্রাণহানিও হয়েছে।”

“বর্তমান সরকারের উচিত হবে অতি দ্রুত কঠোরভাবে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা। অন্যথায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে,” বলেন তিনি।

সরকার পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ডজন খানেক মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছে বলে বেনারকে জানান মানবাধিকার কর্মী ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান।

তিনি বলেন, “এর কারণ, বিগত সরকার গত ১৫ বছরে পুলিশকে জনগণের মুখোমুখি করে গণদুশমন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সে কারণে সরকারের পতনের পর পুলিশ নির্লিপ্ত ছিল। এমনকি এখনও ভয়ের মধ্যে আছে জনগণ পুলিশের বিরুদ্ধে আবারও আক্রমণাত্মক হয় কি না। এই সুযোগে মবোক্রেসি মাথা চাড়া দিয়েছে।”

নূর খান বলেন, “এই মব জাস্টিসের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, পুলিশ ছাড়া দেশ অচল। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি দেওয়া হলো। কিন্তু তাদের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সম্ভব নয়।”

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, মব জাস্টিসের ঘটনাগুলো আমাদের সবাইকে মর্মাহত করেছে। এ ধরনের ঘটনা এড়াতে যত রকম পদক্ষেপে নেওয়া প্রয়োজন, আমরা নেব। আইনের মাধ্যমে উপযুক্ত তদন্ত ও শাস্তি নিশ্চিত করবে এই সরকার,” বলেন তিনি। 

উল্লেখযোগ্য মব জাস্টিসের ঘটনা

গত ৫ সেপ্টেম্বর খুলনা মহানগর পুলিশ কার্যালয়ের সামনে ইসলামের মহানবীর নামে কটূক্তি করার অভিযোগ এনে খুলনায় উৎসব মন্ডল (২২) নামের এক হিন্দু ছেলেকে পিটিয়ে জখম করে স্থানীয় জনতা।

গত ৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে মাসুদ নামের এক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এদিন বগুড়ায় ইউটিউবার হিরো আলমকে আদালত চত্বরে আক্রমণ করা হয়।

১৪ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে একদল উত্তেজিত জনতা এক নারীকে কান ধরে উঠবস করাচ্ছে এমন একটি ভিডিও ভাইরাল হয়।

গত ২০ আগস্ট ঢাকার সাভারে ডাকাত সন্দেহে মানিকগঞ্জের শিবালয় এলাকার মজিবর রহমান নামের পঞ্চাশোর্ধ এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয় জনতা।

এর আগে বিগত সরকারের আটক মন্ত্রী-এমপিদের আদালতে নেওয়ার পথে ডিম ছোড়া থেকে শুরু করে শারীরিক আঘাত করে উত্তেজিত জনতা। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান আদালত চত্বরে হামলার শিকার হন। একইভাবে আদালতে নেওয়ার সময় জনতার আক্রমণের শিকার হন সাবেক মন্ত্রী দিপু মণি এবং সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।