রাজনৈতিক দলগুলোর শর্তহীন সংলাপ বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের আহ্বান নাকচ করলেন প্রধানমন্ত্রী
2023.10.31
ঢাকা
চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রাজনৈতিক দলগুলোকে শর্ত ছাড়া সংলাপের আহ্বান জানানোর কয়েক ঘণ্টার মাথায় সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মঙ্গলবার ঢাকায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ভোট গ্রহণের বেশ আগে থেকেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয় জানিয়ে তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে সরকার, রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ভোটার, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব রয়েছে।
“সহিংসতা, জনগণের জমায়েত ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার বাধাগ্রস্ত করা, ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণসহ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে অবমূল্যায়ন করে এমন যে কোনো কাজ সুষ্ঠু নির্বাচনের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে,” বলেন তিনি।
বিরাজমান উত্তেজনা প্রশমিত করতে এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ খুঁজে পেতে সব পক্ষ পূর্বশর্ত ছাড়াই সংলাপে বসতে পারে বলে জানান রাষ্ট্রদূত।
সংলাপ নিয়ে পিটার হাস এই আহ্বান জানানোর কয়েক ঘণ্টা পর গণভবনে অনুষ্ঠিত হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন।
এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “কার সঙ্গে সংলাপ, বিরোধী দলটা কে? সংসদীয় রীতিতে সংসদের বিরোধী দল হলো প্রকৃত বিরোধী দল। এর বাইরেরগুলো দল হিসেবে গণ্য হয় না।”
প্রসঙ্গত, বর্তমানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সংসদে কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। বাংলাদেশে সংসদীয় বিরোধীদল জাতীয় পার্টি।
বিএনপির নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেভাবে একজন পুলিশকে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিল ওই খুনিদের সঙ্গে কীসের সংলাপ?
“ওই খুনিদের সঙ্গে ডায়ালগ বাংলাদেশের মানুষও চাচ্ছে না। বরং বাংলাদেশের মানুষ তাদের ঘৃণা করে। বিএনপি-জামায়াতকে ঘৃণা করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।
অপরদিকে পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক শেষে সিইসি হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এসেছিলেন। আমাদের তরফ থেকে খুব স্পষ্ট করে বলেছি, নির্বাচন কমিশনের হাতে কিন্তু কোনো অপশন নেই, নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে হবে।”
অবরোধের প্রথম দিনে ৩ মৃত্যু
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে তিন দিনের অবরোধ পালন করছে বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী ও অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দল।
অবরোধের প্রথম দিনে পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষে কিশোরগঞ্জে বিএনপির দুই কর্মী ও সিলেটে এক কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, কিশোরগঞ্জে বিএনপির দুই কর্মী পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন এবং সিলেটে এক কর্মীকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরেছে পুলিশ।
এ প্রসঙ্গে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. গোলাম মোস্তফা বেনারকে বলেন, মিছিলকারীরা প্রথমে পুলিশের ওপর হামলা চালান এবং তিনি নিজেও আহত হন।
“আমার জানামতে এ ঘটনায় দুইজন মারা গেছেন। তবে সেটি গুলিতে, নাকি অন্য কোনো কারণে মারা গেছেন, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না,” বলেন গোলাম মোস্তুফা।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ গণমাধ্যমকে জানান, অবরোধ চলাকালে পিকেটিং করার সময় পুলিশ পিকেটারদের ধাওয়া দেয়। এ সময় একটি মোটরসাইকেল গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুইজন আহত হয়েছিলেন। স্থানীয়রা তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন, দুপুরের দিকে একজন মারা যান।
কর্মী মৃত্যুর প্রতিবাদে অবরোধের মধ্যেই বুধবার কিশোরগঞ্জে আধাবেলা ও সিলেটে সারাদিন হরতাল ডেকেছে বিএনপি।
এছাড়া নারায়ণগঞ্জে বিএনপি পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে তিন পুলিশ সদস্যসহ কমপক্ষে ২০জন আহত হয়েছেন।
গত ২৮ অক্টোবর বিনিএপির মহাসমাবেশের দিন থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত সারাদেশে সহিংসতায় কমপক্ষে দশ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ছয় জন বিএনপি সমর্থক এবং একজন করে সরকারি দলের সদস্য, পুলিশ, সাংবাদিক ও পরিবহন শ্রমিক।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ
মঙ্গলবার কর্মসূচি পালনকালে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয় দলের কর্মীদেরই লাঠি হাতে দেখা গেছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা রিজভী বেনারকে বলেন, “শুরু থেকেই আমাদের কর্মীরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছে। কোথাও কোথাও পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের হামলার মধ্যে পড়ে তাৎক্ষণিকভাবে কুড়িয়ে পাওয়া লাঠি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে।”
লাঠি হাতে আওয়ামী লীগ কর্মীদের মাঠে থাকা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমাদের কর্মীরা জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় মাঠে আছে। তাঁরা কোনো সহিংসতা করছে না বরং সহিংসতা রুখে দিতে কাজ করছে।”
মির্জা আব্বাস ও আলাল আটক
ঢাকার সাবেক মেয়র, সাবেক মন্ত্রী, বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে শাহজাহানপুরের শহীদবাগ মসজিদ গলি এলাকা থেকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
মঙ্গলবার রাত সোয়া ৮ টার দিকে তাঁকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ।
কাছাকাছি সময়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
বিএনপি'র প্রেস উইং এর সদস্য শামসুদ্দিন দিদার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
গত রোববার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করার পর বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
পুলিশ ও বিএনপির তথ্যমতে, গত শনিবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, যাদের বেশিরভাগই বিএনপির সদস্য।
“আমরা যাদের আটক করেছি তারা অপরাধ করেছেন। অপরাধ করলে আটক হবেন এটিই স্বাভাবিক,” মঙ্গলবার বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
“প্রতিটি সহিংস ঘটনার জন্য অনেক মামলা হবে। শত শত মামলা হবে,” যোগ করেন তিনি।
সহিংসতাকে উসকে দেয় এমন কাজ করবেন না: জাতিসংঘ
বাংলাদেশে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া সহিংসতার ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করে মঙ্গলবার এক বিবৃতি দিয়েছেন জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার লিজ থ্রসেল।
“সহিংসতা অগ্রহণযোগ্য” উল্লেখ করে বিবৃতিতে তিনি সকল রাজনৈতিক দলকে সহিংসতা উসকে দিতে পারে এমন বিবৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।
“আমরা আশা করি পুলিশ চরম প্রয়োজন না হলে যেন শক্তি প্রয়োগ না করে,” উল্লেখ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার বলেন, “নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের সময় সকল বাংলাদেশির মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”