টানা অবরোধে রাজধানী কার্যত বিচ্ছিন্ন

আহম্মদ ফয়েজ
2023.11.06
ঢাকা
টানা অবরোধে রাজধানী কার্যত বিচ্ছিন্ন বিএনপির ডাকা দ্বিতীয় দফা অবরোধের শেষ দিনে রাস্তায় স্বাভাবিকের তুলনায় গণপরিবহন কম ছিল। ছবিটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাতুয়াইল এলাকা থেকে তোলা। ৬ নভেম্বর ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর চলমান অবরোধের ফলে রাজধানী ঢাকা কার্যত দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

বিচ্ছিন্ন সহিংসতা, যানবাহনে আগুন ও বড়ো শহরগুলোতে ক্ষমতাসীনদের সরব উপস্থিতি এবং পুলিশের অভিযানে বিরোধীদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে রোববার থেকে শুরু হওয়া ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি মঙ্গলবার শেষ হবে।

সোমবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বুধবার থেকে সারা দেশে আরও ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।

পাশাপাশি একই সময়ে অবরোধ পালনের ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ ও লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) যুগপৎ আন্দোলনের অন্যান্য শরিক দলগুলো।

সোমবার রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। টিকিট কাউন্টারগুলো ছিল বন্ধ।

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে লক্ষ্মীপুরগামী বাস আল-আরাফাহ কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতা মহসিন বেপারীর সঙ্গে কথা হয় বেনারের। সে সময় তিনি কাউন্টার বন্ধ করে পাশেই অবস্থান করছিলেন।

মহসিন বলেন, “মহাসড়কে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীরা অবরোধ সৃষ্টি করে রাখায় গাড়ি চালানো খুবই বিপজ্জনক। তাছাড়া যাত্রীও নেই।”

বিরোধীদের গ্রেপ্তার, ইইউ-যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

রিজভী অভিযোগ করেন, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ কর্মসূচিকে ঘিরে শুরু হওয়া পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর চলমান কর্মসূচির মধ্যে পুলিশ অব্যাহতভাবে গ্রেপ্তার অভিযান চালিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।

তিনি বলেন, “বিএনপি ঘোষিত ও গণতন্ত্রকামী সমমনা দলগুলো সমর্থিত অবরোধ কর্মসূচিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী ক্যাডারদের যৌথ আক্রমণে দেশের সর্বত্র আতঙ্ক ও ভয়ের যুদ্ধকালীন উদ্বিগ্নতা বিরাজমান।”

সোমবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে রিজভী জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ২৭৫ জনের বেশি নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন।

তিনি আরও জানান, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের তিন-চার দিন আগে থেকে সোমবার পর্যন্ত পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী। গত ২৮ ও ২৯ জুলাই থেকে গ্রেপ্তার এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আট হাজারের বেশি। এই সময়ে ৪০ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে আসামি করে নতুন মামলা হয়েছে পাঁচ শতাধিক।

গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন থানায় গত নয় দিনে নতুন করে দায়ের করা ১০২টি মামলায় রোববার পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক হাজার ৫৫৪ জনকে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার কে এন রায় নিয়তি সোমবার সন্ধ্যায় গণমাধ্যমকে জানান, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ও শামসুজ্জামান দুদু এবং বিএনপি মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন।

সারা দেশে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।

রোববার এক এক্স (সাবেক টুইটার) বার্তায় ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল লেখেন, “বাংলাদেশে আট হাজারের বেশি বিরোধী নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তারে উদ্বেগ জানাচ্ছি। প্রতিটি মামলায় অবশ্যই ন্যায় বিচার হতে হবে। আমরা সব পক্ষকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করি।”

ইইউর এই বার্তাকে সমর্থন জানিয়ে নিজেদের এক্স হ্যান্ডলে শেয়ার করেছে বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসও।

তবে ইইউর বিবৃতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সোমবার বলেন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবৃতিতে তথ্য ঘাটতি রয়েছে। সেটি (তথ্য ঘাটতি) সংশোধন করা হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

IMG_1665.jpg
বিএনপির ডাকা অবরোধের বিরুদ্ধে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে লাঠিসোঁটা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থান। ৬ নভেম্বর ২০২৩। [বেনারনিউজ]

সহিংসতার জন্য ক্ষমতাসীনদের দায়ী করছে বিরোধীরা

গত ২৮ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত সংঘটিত সহিংসতার জন্য ক্ষমতাসীনদের দায়ী করছেন বিরোধী দলের নেতারা।

সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, “বিএনপি গণতন্ত্রের, সুষ্ঠু ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলনে থাকলেই আওয়ামী সরকারের শুরু হয় গুম ও ক্রসফায়ারের উৎসবের ঋতু। তারা শুরু করে আগুন নিয়ে খেলা। বাসে আগুন দিয়ে দায় চাপায় গণতন্ত্রের পক্ষের বিপ্লবী কর্মীদের ওপর। যার অসংখ্য প্রমাণ এখন মানুষের হাতে হাতে।”

তিনি বলেন, “গত ২৮ অক্টোবর পরিকল্পিতভাবে পুলিশ রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে সমাবেশ ভণ্ডুল করে দেয়। বিএনপির একজন নেতা পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। পুলিশ ও আওয়ামী ক্যাডারদের যৌথ সহিংসতায় পুলিশের একজন সদস্য নিহত হন। প্রকৃত সন্ত্রাসীদেরকে আড়াল করে দলের মহাসচিবসহ জাতীয় নেতাদের ওপর দায় চাপিয়ে কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।”

এদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক গণতন্ত্র মঞ্চ আয়োজিত সমাবেশে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকি বলেন, ২৮ তারিখ ক্ষমতাসীনরা তাদের এজেন্ট দিয়ে সহিংসতা করিয়েছে। প্রধান বিচারপতির বাড়ির ফটকে হামলা করেছে এবং নির্মমভাবে পিটিয়ে একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছে। নিজেদের এজেন্ট ঢুকিয়ে এসব করে তারা বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে।”

রাজধানীর নয়াপল্টনে গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের দিন থেকে সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সারা দেশে ১১০টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

এতে আরও উল্লেখ করা হয়, গতকাল রোববার ভোর ৪টা থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশে ২১টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে ১২টি ও বাকিগুলো ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায়।

পুড়ে গেছে ১৫টি বাস, দু’টি ট্রাক, একটি প্রাইভেট কার, একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও একটি হিউম্যান হলার (লেগুনা)।

ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি

চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা ও অবরোধ কর্মসূচির কারণে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতা, হরতাল ও অবরোধের কারণে দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

“সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ছে, রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে। এই অবস্থা দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো নয়,” বলেন তিনি।

এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, “সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসতে হবে। ক্ষমতাসীনদেরই মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে। বিরোধীদের শুধু জেলে পাঠানো সমাধান নয়।”

সংকট সমাধানে বিভিন্ন মহল থেকে আলোচনার প্রস্তাব উঠে এলেও আলোচনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের সোমবার বলেছেন, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।

এর আগে গত শনিবার ৪৪ টি দলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন আয়োজিত আলোচনা সভা বয়কট করে বিএনপিসহ ১৮টি রাজনৈতিক দল।

সভা শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য দলগুলোকেই উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “সেই সংকট নিরসন করার সামর্থ্যটা আমাদের নেই বা আমাদের সে ম্যান্ডেটও নেই। আমরাও বলেছি; আপনারাও নিজেদের মধ্যে চেষ্টা করতে পারতেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।