বিরোধীদলের মৃত, কারাবন্দি এবং প্রবাসী ব্যক্তিও মামলার আসামি
2023.11.14
ঢাকা
“আমার স্বামী মারা গেছে এক বছর আগে, ২০২২ সালের অক্টোবরে। আমাদের পরিবারের খবর কেউ নেয়নি। এখন আমার মৃত স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। আমি মামলার বাদীকে শুধু বলব, সম্ভব হলে তাকে কবরে গিয়ে আটক করতে।”
এভাবেই নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঢাকার রামপুরা থানার ২৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. নাসির রহমানের স্ত্রী রিনা আক্তার।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হচ্ছে নতুন নতুন মামলা, প্রতিদিনই গ্রেপ্তার হচ্ছেন শতাধিক নেতাকর্মী।
গত কয়েক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন থানায় দায়ের মামলাগুলোর কমপক্ষে ১০টি এজাহারে দেখা গেছে, কয়েক বছর আগে মারা যাওয়া বিএনপি নেতা, দীর্ঘ দিন ধরে কারাবন্দি এবং অনেক দিন ধরে বিদেশে থাকা নেতাদেরও আসামি করা হয়েছে।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিএনপির মহাসমাবেশ থেকে ফেরার পথে রাজধানীর মৌচাক এলাকায় “পুলিশের ওপর আক্রমণ, ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগ, ককটেল ছোড়া এবং রামপুরায় পুলিশ বক্সে হামলা করে ক্ষতিসাধনের” অভিযোগে দায়ের মামলায় অন্যদের সাথে এক বছর আগে অসুখে মারা যাওয়া নাসিরসহ বিএনপির প্রয়াত দুই নেতাকেও আসামি করেছে পুলিশ।
মামলার অন্য আসামি সাড়ে তিন বছর আগে মারা যাওয়া বিএনপির সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া।
রামপুরা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আব্দুল জলিল বাদী হয়ে গত ২৯ অক্টোবর মামলাটি দায়ের করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বেনারকে বলেন, সহিংসতার ঘটনায় “স্থানীয়দের তথ্যের ভিত্তিতে মামলার আসামিদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”
আসামি তালিকায় “যদি কোনো ত্রুটি থাকে, তা তদন্তকালে ঠিক করে নেওয়া হবে,” বলে জানান তিনি।
তবে সানাউল্লাহ মিয়ার সহকর্মী আইনজীবী সৈয়দ নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে অনেক গায়েবি ও মিথ্যা মামলা দায়ের করা হচ্ছে। মৃত দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা তারই একটি উদাহরণ।”
সানাউল্লাহ ২০২০ সালে মারা গেছেন জানিয়ে তাঁর ছেলে শফিকুর রহমান রানা বেনারকে বলেন, “বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ যেসব ভুয়া ও কাল্পনিক মামলা করছে, তার একটি উদাহরণ এটি।”
জেলে থেকেও আসামি, বিদেশে থেকেও আসামি
বিএনপির ঢাকায় মহাসমাবেশের আগে গত ২৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন গাজীপুরের বিএনপির নেতা শেখ শামিম ও সাইফুল আলম খান। বিএনপির এই নেতারা এখনো কারাগারে আছেন।
কিন্তু গত ৩১ অক্টোবর টঙ্গী পশ্চিম থানায় নাশকতার অভিযোগে দায়ের করা এক মামলায় অন্যদের সাথে শামিম ও সাইফুলকে আসামি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আইন উদ্দিন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে টঙ্গী পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, ৩১ অক্টোবরের ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার কয়েকজনের দেওয়া “তথ্যের ভিত্তিতে অন্য আসামিদের নাম দেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “গ্রেপ্তার ব্যক্তিরাই আমাদের বিভ্রান্ত করতে হয়তো এমন তথ্য দিয়েছেন।”
একইভাবে ঘটনার দিন সৌদি আরবে হজে থাকলেও ২ নভেম্বর টঙ্গী পশ্চিম থানা এলাকায় গাড়ি ভাঙচুরের একটি মামলায় গাজীপুর সিটির ৫২ নম্বর ওয়ার্ড জামায়াতের সাবেক আমির মো. মকবুল হোসেনকে আসামি করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান তাঁর ভাই মানিক হোসেন।
মামলাগুলোর প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে কোনো ভুল থাকলে তা “তদন্তকালে সংশোধন করে নেওয়া হবে,” বলেও জানান ওসি সাখাওয়াত।
‘আইনের প্রতি চরম অসম্মান’
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ শিরোনামে ছিল মৃত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ঘটনা।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে ১৬ অক্টোবর বিবিসি বাংলায় “বিএনপির বিরুদ্ধে ‘গায়েবি মামলা': সব ঘটনার বিবরণ যখন একইরকম, কিন্তু আদৌ ঘটেছিল কি না তা বলতে পারছেন না কেউ” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার আগে দেড় মাসে এ রকম মামলার সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়ে যায়; যেসব মামলায় জ্ঞাত-অজ্ঞাত মিলিয়ে মোট আসামি পৌনে চার লাখ।
বিবিসির ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সে সময় মামলায় উল্লেখ করা ঘটনার আগেই মৃত্যু হয়েছে—তেমন আসামির সংখ্যা ছিল সাত।
নির্বাচনকে সামনে রেখে এবারও ‘গায়েবি’ মামলা করা হচ্ছে উল্লেখ করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলছেন, এসব মামলার উদ্দেশ্য বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঘরছাড়া করা।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বেনারকে বলেন, “গায়েবি মামলা বিরোধী দমনে ক্ষমতাসীনদের পুরোনো কৌশল। কিন্তু এভাবে হয়রানি করতে গিয়ে যখন মৃত ব্যক্তি, জেলে থাকা ব্যক্তি বা প্রবাসে থাকা ব্যক্তিদের আসামি করে; তখন এটা প্রমাণ হয়ে যায় যে, এসব মামলা ভিত্তিহীন।”
তিনি বলেন, “দেশে যদি আইনের শাসন থাকত, তাহলে এসব ঘটনার জন্য সরকার বা পুলিশকে জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে হতো।”
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “গায়েবি মামলা বলে কিছু নেই। কখনো কখনো সাক্ষী বা গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে বা না জেনে পুলিশকে ভুল তথ্য দেয়। সে হিসেবেই আসামি করা হয়।”
“কোনো মৃত ব্যক্তি বা অনুপস্থিত ব্যক্তি যদি আসামি হয়েও যায়, তদন্তকালে নাম বাদ পড়ে,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এদিকে যারা এসব মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলায় আসামি হচ্ছেন তাঁরা যে ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন না, তা একটা দীর্ঘমেয়াদি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই প্রমাণ করতে হবে বলে বেনারকে জানান আইনবিদ শাহদীন মালিক।
তিনি বলেন, এর ফলে তাঁদেরকে “দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ায় হয়রানির পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির মধ্যেও” পড়তে হবে।
তাঁর মতে, গায়েবি মামলা বা ঘটনা সাজিয়ে মামলা করা আইনের প্রতি চরম অসম্মান। “এর ফলে দেশের নাগরিকদের সংবিধান প্রদত্ত সব মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।”
“শুধু হয়রানির উদ্দেশ্যে এসব মামলা দায়েরের প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে, নাগরিকরা প্রজায় পরিণত হচ্ছে,” বলেন শাহদীন মালিক।